নিজাম উদ্দিন: লক্ষ্মীপুর সদরের তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের আঁধার মানিক গ্রামে থাকা ‘জেবি গোল্ডেন’ নামক একটি ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে গাছপালা পুড়ে গেছে। এতে ওই এলাকার পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। ভাটার আশেপাশের কৃষি জমিতেও কৃষি উৎপাদন কমে গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ভাটার চারপাশেই কৃষি জমি এবং বসতবাড়ি। এর ভেতরেই অবৈধভাবে ভাটা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। যার কারণে আশপাশের লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও পড়েছে তারা। পরিবেশ দূষণ এবং পরিবেশের বিপর্যয় ঘটালেও ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, ভাটার মৌসুম শেষ হওয়ায় সম্প্রতি ‘জেবি গোল্ডেন’ নামক ভাটার আগুন নেভানো হয়। আগুন নেভানোর সাথে সাথে ভাটার তীব্র তাপ আশপাশে থাকা গাছপালাতে গিয়ে পড়েছে। এতে গাছের ডালপালা জ্বলসে গেছে।
জানা গেছে, ইটভাটার মালিক সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চৌরাস্তা এলাকার নুরুল আলম ছুট্টু। ভাটার অবস্থান একই উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আঁধার মানিক গ্রামে। গত ৮ থেকে ১০ বছর ধরে ফসলি জমির মাঠে ভাটাটির কার্যক্রম চলছে। ভাটার আগুন নেভানোর সময় আশপাশে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে স্বীকারও করেছে ভাটা মালিক।
লক্ষ্মীপুরের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষক সানা উল্লাহ জানান, ইটভাটার কালো ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস থাকে। এসব গ্যাসের সাথে সরাসরি পানি মেশানোর ফলে পরিবেশ ধ্বংসকারী অজৈব এসিড উৎপন্ন হয়। তাই একটি ভাটা বন্ধ করার সময় ভাটাতে সরাসরি পানি না মিশিয়ে আগে ক্ষার জাতীয় রাসায়নিক মেশাতে হয়। এরপর কমপক্ষে এক সপ্তাহ যাবত পর্যায়ক্রমে ভাটার আগুনে পানি ঢেলে নেভাতে হয়। কিন্তু ভাটার মালিকরা রাসায়নিক না মিশিয়ে এবং দীর্ঘ সময় পানি না ছিটিয়ে রাতারাতি বন্ধ করার কারণেই মূলত ভাটা এলাকার আশাপাশে মারাত্মক পরিবেশ ঝুঁকি তৈরি হয়।
শনিবার (১৫ জুন) দুপুরে সরেজমিনে ভাটা সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। ভাটার আশেপাশের বাড়িগুলোতে থাকা নারিকেল, সুপারী, পেয়ারা, আমড়াসহ বিভিন্ন ফলজ এবং বনজ গাছের ডালপালা জ্বলসে আছে। গাছ থেকে অপরিপক্ক ফল ঝড়ে পড়ছে। বসতবাড়িগুলোতে হাজার হাজার নারিকেল গাছ আছে, যেগুলোতে এখন আর নারিকেল ধরে না৷ ভাটার তীব্র তাপে গাছপালার উপর এমন প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছে ক্ষতিগ্রস্তরা।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভাটার উত্তর পাশে থাকা মোশাররফ খোনার বাড়ির বাসিন্দারা। ভাটার তীব্র তাপে ওই বাড়ির সকল গাছপালা বিবর্ণ রং ধারণ করেছে। এতে চরম ক্ষতি হয়েছে তাদের। ফলে অবৈধ ভাটা বন্ধসহ ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
ক্ষতিগ্রস্ত মো. হানিফ বলেন, গত ৬ থেকে ৭ দিন আগে ভাটার আগুন নেভানো হয়। আগুন নির্দিষ্ট একটা নিয়মে নেভানোর কথা। এ ক্ষেত্রে ভাটা মালিকের খরচ বেশি পড়ে। কিন্তু নিজের খরচ বাঁচানোর জন্য ভাটার আশপাশের বাসিন্দাদের ক্ষতি করেছে ভাটা মালিক। হুট করে ভাটার আগুন নিভিয়ে দেওয়ার বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয়েছে। গ্যাস এবং তীব্র তাপমাত্রা আমাদের গাছপালাতে আঘাত করেছে। এতে বাড়ির নারিকেল, সুপারী, আমড়া, পেয়ারাসহ সকল গাছ জ্বলসে গেছে। গাছ থেকে আমড়া সব ঝরে গেছে।
কৃষিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে ভাটার পাশে থাকা দেড়কানি জমিতে চাষবাদ করেছি। ভাটার তাপে ধানগাছ জ্বলসে গিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছিলো। পরে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করি। যেখানে ১৫০ মন ধাণ উৎপাদন হবে বলে আশা করেছি, সেখানে অর্ধেকের চেয়ে কম ৬০ মন ধান পেয়েছি। ভাটা মালিক ক্ষতিপূরণ বাবদ মাত্র ৪ হাজার টাকা দিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. রুবেল বলেন, ভাটার তাপে আমাদের বাগানের শত শত সুপারী গাছ জ্বলসে গেছে। নারিকেল গাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা চরম ক্ষতির শিকার হয়েছি। ভাটার প্রভাবে এলাকায় কোন কৃষি আবাদ হয় না। কোন কোন সময় ভাটাতে থাকা কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি পাশের ফসলি জমিতে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ এতে জমির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। ফসল নষ্ট হয়।
মো. কাজল নামে আরেকজন বলেন, প্রতি বছর ভাটার প্রভাবে আমরা এ ধরণের ক্ষতির শিকার হচ্ছি। অবৈধ ভাটার বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়না। ভাটার পাশের গাছাপালা তো জ্বলেই গেছে, সাথে ক্ষেতের বন-জঙ্গলও জ্বলে গেছে। বিষাক্ত ধোঁয়ায় পরিবেশের এমন ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
ভাটার পাশে থাকা মোস্তফা হাওলাদার বাড়ির বাসিন্দা সবজি চাষী মো. মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ৮ থেকে ১০ বছর ধরে এমন অবস্থা চলছে। আমি এবার ৬০ শতাংশ জমিতে সবজির আবাদ করেছি। কিন্তু ভাটার প্রভাবে সবজি আবাদ হচ্ছে না৷ জমিতে চারা গাজালেও মরে যায়। আবার ফলন ধরলে ঝরে পড়ে যায়। ভাটার তাপ ফসল সব নষ্ট করে দেয়।
তিনি জানান, তাদের বাড়িতে প্রায় চার শতাধিক সুপারী এবং পাঁচ শতাধিক নারিকেল গাছ আছে। সেগুলোতে এখন আর ফলন হয়না। ইট ভাটার প্রভাবে এমনটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মনির হোসেন বাবলু বলেন, আবাসিক এলাকা এবং ফসলি মাঠে ইটভাটা হয় না। কিন্তু জেবি গোল্ডেন ভাটাটি আমাদের অনেক ক্ষতি করতেছে। অবৈধ ভাটার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়না, জানিনা। ভাটার বিরুদ্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করি।
ভাটার পাশের আরেক বাসিন্দা হারুনুর রশিদ বলেন, ভাটায় ইট পোড়ানোর সময় তীব্র গন্ধ ছড়ায়। যা যা মানুষের এবং পশু-পাখির স্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর। এতে শিশু, বৃদ্ধসহ অনেকে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ভূগছে।
ভাটা মালিক নুরুল আলম ছুট্টু বলেন, আগুন নেভানোর সময় বাতাসের বিপরীত অংশে কিছু ক্ষতি হয়। গেল বছর বা তার আগে এমন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এবার গাছপালার সামান্য ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় দুইজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে বলেছি, কার কি ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো দেখার জন্য। তাদেরকে নিয়ে বসে বিষয়টি সমাধান করা হবে।
ভাটার কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, এ এলাকায় তো শুধু আমার ভাটা নয়, অনেকগুলো ভাটা আছে। ভাটা থাকলে পরিবেশের একটু সমস্যা হয়।
এ বিষয়ে জানতে শনিবার (১৫ জুন) দুপুরে লক্ষ্মীপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ পাঠানের মুঠোফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
0Share