সব কিছু
facebook lakshmipur24.com
লক্ষ্মীপুর বৃহস্পতিবার , ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
করোনাকালে আমার সহচরগণ কেউ ঘুমিয়ে, কেউ চাপে

করোনাকালে আমার সহচরগণ কেউ ঘুমিয়ে, কেউ চাপে

করোনাকালে আমার সহচরগণ কেউ ঘুমিয়ে, কেউ চাপে

রফিকুল ইসলাম মন্টু: সহচরগণের এখন অবসর। কেউ ঘুমাচ্ছে; কেউবা বিশ্রামে। কেউ আবার সেই যে কবে ফিল্ড থেকে কর্মযজ্ঞ শেষ করে এসে প্যাকেটবন্দি হয়েছে; আর বের হয়নি। কারোনাকালে আমারও অবসর। কখনো ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে দেখি, ওরা কে কেমন আছে? অপ্রয়োজনেই উল্টেপাল্টে দেখি কারও কোন সমস্যায় আছে কীনা? বিপদে-আপদে ওরাই আমার সহচর, সঙ্গী, বন্ধু, একান্ত সাথী। আমার জন্য যে খাটুনিটা ওদের! এটা হয়তো লিখে শেষ করা যায় না। এই সঙ্গীগণ না থাকলে আমার কাজই হয়তো বন্ধ হয়ে যেতো। ওদের প্রায় সকলকেই বিশ্রামে পাঠিয়েছি। কেউ কেউ দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে এই করোনাকালের সংকটেও কারও ওপর দিয়ে যাচ্ছে প্রচন্ড চাপ।

উপক‚লের পথেঘাটে ঘুরতে, এখানে সেখানে থেকে কাজ করতে, সহায়তা করে আমার এই বন্ধুগণ। আজ হঠাৎ করেই মনে হলো, পৃথিবী যখন ঘরবন্দি, আমার বন্ধুগণও তো আজ একই অবস্থায় সময় পার করছে। কতদিন ওরা বাইরের আলো বাতাস দেখেনি। কেমন আছে ওরা? রোদ বৃষ্টিতে উপক‚লের পথে ছুটে চলার দৃশ্য ওরা দেখছে না কতদিন। দমকা হাওয়া, মেঘের গর্জন, নদী-সমুদ্রের ঢেউ, ট্রলার উথাল পাতাল ছুটে চলার দৃশ্যগুলো হয়তো ওদেরও মনে পড়ছে। সেসব দৃশ্য মনে পড়ছে আমারও। আমি দেখি কত মানুষের মুখচ্ছবি। কত চেনা জনপদ। একা পথে রাতে হারিয়ে যাওয়ার সময়টার কথা মনে পড়ে। আমার মনে পড়ে যায় উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে যেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম, সেদিনের কথা। একবার রাতে সাপের ছোবলে ভয় পাওয়ার পর আবিস্কার করলাম লাইফবয় সাবান থেরাপি। এর মানে লাইফবয় সাবানে কার্বোলিক এসিড থাকে। সাপ কার্বোলিক এসিড ভয় পায়। তাই দুর্গম জনপদে কোথাও ঘুমানোর সময় লাইফবয় সাবান চার টুকরো করে বিছানার চার কোনায় রেখে দিতাম। মনকে সান্তনা দিতাম, এখানে কার্বোলিক এসিড আছে, সাপ আসবে না। আরও কত কী বিচিত্র সব বিষয়াদি! আমার সহচরদের মনেও হয়তো এমন অনেক কথা উঁকি দিচ্ছে করোনার এই ঘরবন্দিকালে।

আমার ক্যামেরা। নাইকন ৫৩০০। বেশ বিচক্ষণ সে। তার চোখ যে কতকিছু দেখেছে। উপক‚লের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত সব চিনে আমার ক্যামেরা। হাজারো বঞ্চিত-অবহেলিত মানুষের মুখ সে দেখেছে। চোখে চোখ রেখেছে। সে দেখেছে কীভাবে ভাঙনে বিলীন হয় গ্রামের পর গ্রাম। বহু মানুষকে সে কাঁদতে দেখেছে। বহু মানুষকে হাসতেও দেখেছে। শিশুদের ডুবসাঁতার, নারীদের জীবিকার খোঁজে ছুটে চলা, কৃষকের হালচাষের দৃশ্য বহুবার অবলোকন করেছেন আমার প্রিয় নাইকন। দূরের ছবি দেখতে সে কখনো ওরই ঘনিষ্ট সঙ্গী ৫৫-৩০০ লেন্সের সাহায্য নিয়েছে। মানুষের মানচিত্রে ওরা হাসিমাখা মুখের ছবিও যেমন দেখেছে; তেমনি আবার প্রবল রাগের মুখেও পড়েছে। ছবি তোলা পাপ বলে অনেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। আবার কেউ রাগান্বিত হয়ে বলেছে- ছবি তোলেন ক্যান, আমরা তো কিছু পাই না। আবার কারও পাল্টা প্রশ্ন- আমাগো ছবি নিয়া ব্যবসা করবেন? কেউ কেউ বলেছে- এত ছবি তুললেন অবস্থার তো বদল হলো না। এসব কিছুর সাক্ষী আমার ক্যামেরা-লেন্স যুগল। পিন পতন নিরবতায় ঘুমিয়ে আছে ক্যামেরাটি। তার পাশেই ঘুমাচ্ছে লেন্সটি। ওরা হয়তো ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের দেশে উপক‚লের সেইসব দৃশ্যই দেখে চলেছে; যা এতদিন ধরে দেখেছিল বাস্তবে।

এই করোনার দুর্দিনে আমার যে সহচর সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে; ওদের প্রতি আমি খুবই কৃতজ্ঞ। এখানে একটি নাম বললে হবে না; দু’জনকেই দিতে হবে এই কৃতিত্ব। একজন ল্যাপটপ, আরেকজন মোবাইল ফোন। এদের মধ্যে আবার ল্যাপটপের ওপর দিয়ে ঝক্কি ঝামেলা একটু বেশিই যায়। কেননা, ঘরবন্দি সময়কালে প্রায় ১০ ঘন্টা আমি ওর সাথেই কাজ করি। আজকাল রমজানে ইফতারের পর পর ওর সঙ্গে; ছুটি সেই ভোর ৫টা, ৬টা, কখনো ৭টা। ওর বাটনে টিপে টিপে আমি খবর বানাই। নেট দুনিয়ায় প্রবেশ করি। ই-মেইল আদান প্রদান, খবর প্রেরণ, এমনকি ছবি এডিটিং, ভিডিও এডিটিংয়ের কাজগুলোও হয় ওরই বুকেই। ১১.৫ ইঞ্চি সাইজের অ্যাসার ল্যাপটপটি না হলে আমার যে কীভাবে সময় কাটতো; কল্পনা করতে পারছি না। করোনাকাল বলে কোন কথা নয়, সব সময়ই ল্যাপটপ আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনে সাড়া দেয়। আবার ওকে ভোগান্তিতেও পড়তে হয় অনেক। উপক‚লের দুর্গম জনপদের অনেক স্থানে বিদ্যুত নেই। বিকল্প জেনারেটর বা সূর্যবাতি। সূর্যবাতিতে সবখানে চার্জ হয় না। জেনারেটরের সাহায্য নিয়ে চার্জ দিতে হয়। সবখানে তো জেনারেটরের কানেকশন থাকে না। তাই চার্জ নিতে আমার ল্যাপটপকে যেতে হয় মুদি দোকানে, ফটোকপিয়ারের দোকানে, ছবি তোলার স্টুডিওতে, এমনকি লোহালক্করের দোকান অবধি। এভাবে উপক‚লে ঘুরে ঘুরে আমার সঙ্গে ল্যাপটপও অর্জন করেছে অনেক অভিজ্ঞতা।

আমার ল্যাপটপ আমার বিশাল তথ্যের ভান্ডার। ওর কাছে থাকা পুরানো ফাইলগুলো চাইতেই মুহূর্তে বের করে দেয়। আমার সেসব খুবই কাজে লাগে। এই ল্যাপটপের আবার দুই সঙ্গী আছে; এক্সার্টানাল হার্ডডিস্ক। এই যে এত এত ছবি তুলি, ভিডিও করি, দিনে দিনে জমে অনেক ফাইল। এগুলো কোথায় রাখি! বৃহৎ জায়গা নিয়ে আমাকে সাহায্য করছে আমার দুই এক্সার্টানাল। ওদেরকে রাখতে হয় খুবই সাবধানে। ওদের মন ভারি স্পর্শকাতর। অল্পতেই ওদের মন খারাপ হয়; দু:খ পায়। বেশি কষ্ট পেলে ওদের কাছে রাখা তথ্য-উপাত্ত আবার হারিয়েও ফেলতে পারে। আমার দুই এক্সার্টানাল চাইলে এই অবসরে বসে বসে সারা উপক‚ল একবার দেখেও নিতে পারে। কেননা ওদের কাছেই গোটা উপক‚লের আর্কাইভ। হয়তো সে সময় ওরা পেয়ে ওঠে না; কেননা করোনার ক্রান্তিকালে ওদের দু’জনকেই আমি প্রায়ই কাছে ডাকি। ওরা তো আবার ল্যাপটপেরও সহযোগী। আমার আরেক অতি প্রয়োজনীয় সঙ্গী মোবাইলের কথা না বললে সে হয়তো রাগ করে ফেলতে পারে। অনেককে দেখেছি দুটো মোবাইল রাখতে। আমার একটাই মোবাইল; হুয়াওয়ে নোভা-টু-আই। বেশ ভালো সার্ভিস তার। করোনাকালে ল্যাপটপের কাছাকাছি সেবা দিচ্ছে আমাকে। নেটের সঙ্গে সারাক্ষণ কানেক্ট রাখছে। যে কোন সময়ে যে কারো সঙ্গে কথা বলতে সাহায্য করছে। ল্যাপটপে না এসে অনায়াসে জরুরি প্রয়োজনগুলো মোবাইলকে দিয়েই সারতে পারি। সে আমার বিপদের বন্ধু।

করোনাকালে আরেক সহচরের ওপর এখন খুব চাপ যাচ্ছে। সে হচ্ছে আমার নোটবুক। পুরানো নোটবুকের পাতা উল্টানো আমার এক রকম অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে। এখন সংকটকালে সে প্রবণতা আরও বেশি। নোটবুক খুলে আমি যেন দেখতে পাই আমার খবরের মানুষদের। উপক‚লের কত জায়গা- এই যেমন, ঢালচর, কালিঞ্চি, সাবরাং, ধানখালী, ভোলানাথপুর, বনবিবিতলা, বুড়িগোলিনী, নীল ডুমুর, চাঁদনিমুখা, ঘড়িলাল, চিলা, বৈটপুর, মদনপুর, উড়িরচর, স›দ্বীপ, হাতিয়া, কুকরি মুকরি, মনপুরা, হরিষপুর, বাউরিয়া, সোনাদিয়া, ধলঘাটা, ডাঙ্গরপাড়া- আরও কত নাম! এসব নাম বলে শেষ করা যাবে না। এই সব স্থানের মানুষের শ্রম ঘাম কষ্টের কথা আছে আমার নোটবুকে। নিরবে নিভৃতে নোটবুকের পাতায়ই হয়তো কাঁদছে একজন ইলিশ শিকারী, একজন কৃষক, ছেলে হারা মা, কিংবা স্বামী হারা এক নারী। আমার চিরন্তর সঙ্গীর জায়গাটা অবশ্যই নোটবুককেই দিয়ে রেখেছি। করোনা সংকটের এই ঘরবন্দি দশায় অনেকগুলো নোটবুক আমাকে এক সঙ্গে সাহায্য করছে। মুখস্থ পাতাগুলো আমি বার বার দেখছি। তথ্য প্রযুক্তির যতই প্রসার ঘটুক; আমার হাতে লেখা নোটবুকের আবেদন ফুরোয় না। এই সহায়তা অন্য কারো কাছ থেকে পাওয়া দুরূহ।

নিবিড়ভাবে সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আমার আরেক সহচর পিঠের ব্যাগ। আমি যেখানেই যাই, ঢাকায় থাকি, কী উপক‚লে থাকি, সে আমার পিঠেই থাকে। আমার সঙ্গে থাকা জরুরি প্রয়োজনের সব উপকরণ সে বহন করে। কখনো কখনো তার ভারটা একটু বেশিই হয়ে যায়। তবুও সে রাগ করে না; বয়ে নিয়ে চলে। আমার ব্যাগটারও আজ মন খারাপ। করোনার খবর শুনে সেই যে কবে সে কাত হয়ে শুয়ে পড়েছে; আর ওঠেনি। হয়তো সেও ঘুমিয়ে আছে। কখনো কখনো আমার প্রয়োজনে তাকে জাগাতে হয়; এটা ওটা বের করার জন্য। কাজ সেরে আবার তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখি। সে যাতে সুস্থ থাকে, নিরাপদে থাকে, সেজন্যে তাকে ঢেকে রেখেছি পুরানো গামছা দিয়ে।

আমার অন্যসব সহচরেরা এখন বিশ্রামে। মাঠে গেলে আমার সঙ্গে দুটো ব্যাগ থাকে। একটির কথা তো বললাম; আমার পিঠেই যার অবস্থান। আরেকটি একটু বড় সাইজের ব্যাগ। তার একদিকে দুটো চাকা রয়েছে। সে বেশ শক্তিশালী। সবসময় কোন না কোন যানবাহনেই চলি সে ব্যাগ নিয়ে। কিন্তু যেখানে যানবাহন নেই; বা যানবাহন পেতে একটু দূর হাঁটতে হবে; সেখানে তো ব্যাগের চাকা দুটোই আমাকে সহায়তা করে। আমার নিত্যপ্রয়োজনীয় যা কিছু এই বড় ব্যাগটিতেই থাকে। টি-শার্ট, প্যান্ট, ¯িøপার জুতো, তোয়ালে, রুমাল, আন্ডারওয়্যার, মোজা, বিছানার চাঁদর, ছাতা, কাগজপত্র, বইপত্র, পুরানো কয়েকটি নোটবুক ইত্যাদি। গরম কালে এই বড় ব্যাগটির ওজন কমে। কেননা, মোটা কাপড় কম থাকে। শীতকালে আমার এই ব্যাগটিতে একটি পাতলা কম্বলও থাকে। ফলে অনেক সময় ব্যাগের মুখ বন্ধ করা বেশ কঠিন হয়। মাঠে অবস্থানকালে এই ব্যাগটির ওপর দিয়ে অনেক চাপ যায়। তবে এখন সে বিশ্রামে। ধুলো ময়লা মুছে তাকে কাপড় মুড়িয়ে রেখে দিয়েছি।

আমার নিত্য সচহরদের মধ্যে আরও যাদের নাম উল্লেখ করতেই হয়; তারা হলো- বলপেন, সাইনপেন, হাইলাইট পেন, ক্যামেরার ট্রাইপোট, মাইক্রোফোন, পেনড্রাইভ, অনেকগুলো চার্জার, ক্যামেরার অতিরিক্ত ব্যাটারি, লাইটার, মোনাজাতউদ্দিনের কয়েকটি বই, ইন্টারনেট মডেম, ছোট সাইজের কাঁচি, বেøড, সুঁইসুতা, ন্যাপথনিল, লাইফবয় সাবান, প্রয়োজনীয় ওষুধ, চিরুনি, শ্যাম্পু, টুথব্রাশ, টুথপেষ্ট, স্যাভলন, ছাতা, রেইনকোর্ট, টিশার্ট, প্যান্ট, জুতো ইত্যাদি নানান কিছু। আমার কাছে এতকিছুর ভিড়ে একটা জিনিস থাকে না। সে কী বলতে পারেন? আয়না। আমার সঙ্গী হিসাবে আয়না রাখার প্রয়োজন অনুভব করিনি কখনো। ফলে আয়নায় নিজের মুখটা দেখা খুব একটা হয়ে ওঠে না। নিজের মুখ দেখার চেয়ে বৃহৎ আয়নার ক্যানভাসে দেখতে চাই উপক‚লীয় জনপদের বিধ্বস্ত চেহারাটা। করোনা শেষে আমার সব সঙ্গীদের ঘুম ভাঙবে। ওরা আবার তৈরি হবে মাঠে যাওয়ার জন্য। সকলে মিলে আবার আমরা দেখবো উপক‚ল।

//রফিকুল ইসলাম মন্টু//০৫.০৫.২০২০//

মতামত | সাক্ষাৎকার আরও সংবাদ

কৃত্রিম ভুলুয়া এখন রামগতি ও সুবর্ণচরের দানব

শতবর্ষী টুমচর ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা

রিপোজটরি সাইট গিটহাবে বাংলাদেশী ডেভেলোপার আরমান হাকিম সাগরের কান্ট্রিবিউশন

নিবন্ধনের জন্য প্রথমদিকে আবেদিত নিউজ পোর্টালগুলোর নিবন্ধন পেতে আর কত বছর?

স্বামীকে গলাকেটে হত্যা | ঘটনার এপিঠ-ওপিঠ

ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে বাংলাদেশেও জেন্ড সার্টিফাইড ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা বাড়ছে

লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ে অনলাইন নিউজপোর্টাল প্রকাশনার নিবন্ধনের জন্য আবেদনকৃত, তারিখ: 9/12/2015  
 All Rights Reserved : Lakshmipur24 ©2012- 2024
Chief Mentor: Rafiqul Islam Montu, Editor & Publisher: Sana Ullah Sanu.
Muktijudda Market (3rd Floor), ChakBazar, Lakshmipur, Bangladesh.
Ph:+8801794 822222, WhatsApp , email: news@lakshmipur24.com