মনজুর মোরশেদ রিংকু: আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে প্লাষ্টিক অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাত পরিস্কার করার প্লাষ্টিকের ব্রাশটি দিয়ে আমাদের দিন শুরু হয়। কফির কাপ, পানির বোতল, খাবারের বাটি সব কিছুতেই যেন প্লাষ্টিকের সামগ্রীর রাজত্ব । কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, যে পানির বোতলে করে প্রতিদিন নিরাপদ মনে করে পানি পান করছি সেই প্লাষ্টিকের পানির বোতলটি আপনার দেহের জন্য কতটা নিরাপদ ?
আসুন আজ জেনে নেই প্লাষ্টিকের পানির বোতল তৈরির উপাদান ও ক্ষতির সম্ভাবনা ।
মূলত দুই ধরনের যৌগ দিয়ে এসব ড্রিংকিং ওয়াটার বা মিনারেল ওয়াটারের বোতল তৈরি করা হয়। এর একটি পলিকার্বন বিসফেনল এ (Bisphenol A) বা বিপিএ এবং অপরটি পলিইথিলিন টেরেফথালেট (Polyethylene Terephthalate) বা পিইটি নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীরা পলিইথিলিনকে নিরাপদ বিবেচনা করলেও বিসফেনল এ (বিপিএ) কে ক্ষতিকারক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কারণ, বিপিএ প্লাষ্টিকের ভিতরের উপাদানের সাথে বিক্রিয়া করে প্লাষ্টিকের উপাদানকে দ্রবীভূত করার ক্ষমতা রাখে। বিভিন্ন উপাদান দ্রবীভূত হয়ে পানির সাথে সহজেই মিশে যেতে পারে এবং পানির সাথে মানবদেহে প্রবেশ করে। বিপিএ এর সাথে মানবদেহের একপ্রকার হরমোনের মিল খুঁজে পাওয়া গেছে যা ওয়েসট্রোজেন মিকি হরমোন (Oestrogen Miki Hormone) মানে পরিচিত।এসব পদার্থ মানবদেহে প্রবেশ করে দেহের স্বাভাবিক হরমোনের কার্যক্রমকে বাধা দেয়।
অষ্ট্রেলিয়ার ক্যাথলিক ইউনিভারসিটির অধ্যাপক, ক্রিস উইন্ডার এক গবেষনায় দেখতে পান, বিপিএ এর কারণে প্রজননতন্ত্রের সমস্যা হওয়া, অতিকায় মোটা হয়ে যাওয়া, গলার ক্যান্সার, ডায়াবেটিকসহ নানা জটিল রোগের উৎপত্তি হতে পারে। এমনকি স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সার সৃষ্টিরও কারণ হতে পারে। ১৯৫০ সাল থেকেই বাণিজ্যিকভাবে প্লাষ্টিক উৎপাদনে এই ক্ষতিকর বিপিএ এর ব্যবহার হয়ে আসছে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষনায় ইতিমধ্যে বিপিএ এর বিষক্রিয়া প্রমানিত হয়ে আসছে।
শুধু তাই নয়, প্লাষ্টিকের বোতলে ক্ষতিকর নিকেল, ইথাইলবেনজিন, ইথিলিন অক্সাইড, বেনজিন, ক্যালারান্ট, প্লাষ্টিসাইজার ও পিগমেন্টের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। ক্যালারান্ট, পিগমেন্ট জাতীয় পদার্থগুলি প্লাষ্টিকের বোতলের রঙ উজ্জ্বল করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এর মাঝে বেশকিছু পদার্থ কারসিনোজেনিক বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে পরিচিত। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে প্লাষ্টিকের বোতল থেকে ক্ষতিকর উপাদান দূর করার যে মানদন্ড নির্ধারন করা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে অন্তত ২২ শতাংশ প্লাষ্টিকের পানির বোতলের ক্ষতিকর মাত্রা নিয়ন্ত্রন করা হয় না।
প্লাষ্টিক বোতল পানির বিশুদ্ধতা এবং মানবদেহে এর ভূমিকা নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়ার পরও কেন পানির ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে এ নিয়ে মার্কিন চিত্র পরিচালক, আলন স্নিটো এবং ডেভোরা কাউফম্যান “থার্ষ্ট” নামে একটি ডকুমেন্টারী ফিল্ম বানিয়েছেন । এতে তারা দেখিয়েছেন,পানি এখন কর্পোরেট জগতের দখলে। শুধু তাই নয়, বহুজাতিক কোম্পানীগুলি পানিকে মৌলিক অধিকার ব্যাখ্যা দিয়ে কিভাবে ভূগর্ভস্থ পানির দখল নিচ্ছে তার প্রমান ও দিয়েছেন।
আশার কথা, ইতিমধ্যে প্লাষ্টিক বোতলজাত পানির বিরুদ্ধে জনমত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে প্লাষ্টিক বোতল পানি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বাংলাদেশেও প্লাষ্টিক বোতল উৎপাদন ও ব্যবহার, পুনরায় ব্যবহার করে পানি, কোমল পানীয় ও ঔষধসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষন ও বাজারজাত করণ বন্ধে হাইকোর্ট রুল জারি করেছে । অধ্যাপক ক্রিস উইন্ডার আশা করছেন, আগামী ১০ বছরের মাঝে প্লাষ্টিক বোতলের ক্ষতি সম্পর্কে সবাই জানবে এবং আগামী ২০ বছরের মাঝে প্লাষ্টিকের বোতলে পানি খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে ।
তাই, আমাদের সবার প্লাষ্টিকের পানির বোতল ব্যবহারে সচেতন হবার এখনিই সময়। আমাদের নিজেকের দেহের সুরক্ষায় এখনি প্লাষ্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে।
লেখক: পরিবেশকর্মী
57Share