মোঃ জহির উদ্দিন: সদর উপজেলার দালাল বাজারে অবস্থিত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িসহ প্রায় শত কোটি টাকার ৩৬ একর সম্পত্তি এখনো রহস্যে ঘেরা। হঠাৎ ওই সম্পদে স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ও দখলে যাওয়ার আভাস পেয়ে দেবোত্তর সম্পত্তি দাবি করে তা রক্ষার আন্দোলনে নেমেছেন
হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। অন্যদিকে সরকারি সম্পদ দাবি করে তা রক্ষা ও উচ্ছেদ অভিযানে প্রশাসনের তৎপরতায় উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে ওই স্থানে বসবাসকারীরা। এসব সম্পত্তি দেবোত্তর নাকি সরকারি সে বিষয়ে ধোয়াশা কাটেনি এখনো।
জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা দালালবাজার জমিদার বাড়ি। লক্ষ্মীপুর জেলা সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে ঢাকা-রায়পুর সড়কের সঙ্গে অবস্থিত দালাল বাজার-সংলগ্ন জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনো দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাড়িটিকে ঘিরে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই।
বাজারে প্রবেশের আগ মুহূর্তে ২২ একর জমিতে দৃষ্টি নন্দন খোয়া সাগরদিঘি। শীতকালে ওই দিঘিতে অতিথি পাখির কলতানও দৃষ্টি কাড়ে সবার। বাজারের পাশেই ১৪ একর সম্পত্তিতে রয়েছে পরিত্যক্ত রাজ গেট, জমিদারি প্রাসাদ, অন্দরমহল, শান বাঁধানো ঘাট, জমিদার বাড়ির প্রাচীর, নির্মাণ সমগ্রী, বিশেষ করে কয়েকটন ওজনের লোহার বিম, বিরাটাকার লোহার সিন্দুক, নৃত্যশালা, বহিরাঙ্গন, তিনটি পুকুর। বাড়িটি দেখতে দূর-দূরান্তর থেকে ছুটে আসে অসংখ্য মানুষ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশ বিভক্তির পূর্বে ১৯৪৬ সালে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজারের জমিদার নবীন কিশোর রায় ও নরেন্দ্র কিশোর রায় প্রায় ৩৬ একর সম্পত্তি রেখে ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে তৎকালীন পাক সরকার জমিদার প্রথা বিলুপ্ত করে এ সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করায় সরকারি সম্পদ হিসেবে পরিণত হয়।
এর সুবাধে ১৯৬৫ সালে আব্দুল মোমেন চৌধুরী সরকারের কাছ থেকে ৭ একর ৮৬ শতক জমি লিজ নেন। পরবর্তীতে চার একর ৮৬ শতক জমি আরও দুই বছরের জন্য লিজ নিয়ে বর্তমান ২০১৫ সালের ২০ জুন অর্থাৎ প্রায় ৫০ বছর পর্যন্ত ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দখলে থেকে বসবাস করেছেন। এছাড়া এসব সম্পত্তির কিছু কিছু স্থানীয় প্রভাবশালীরা স্থানীয় তহসিলদার ও এসিল্যান্ডকে ম্যানেজ করে ভোগ দখল ও মার্কেট নির্মাণ করে দখলে রেখেছে।
গত ২১ জুন সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সমর কান্তির নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দখলদারদের একাংশকে উচ্ছেদ করলেও অন্য দখলদাররা রহস্যজনক কারণে থেকে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অন্যদিকে জমিদাররা চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে জমিদার বাড়ির সেবায়েত হিসেবে ঋষিকেশ চক্রবর্তীকে এসব সম্পদ দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যান বলে জানা যায়। ১৯৬৭ সালে এসব সম্পত্তি শত্রু সম্পতি নয় মর্মে নোয়াখালী সাব জজ আদালতে স্বত্ব ঘোষণামূলক মামলা করেন সেবায়েত ঋষিকেশ। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে ঋষিকেশের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট নোয়াখালী সাব জজ আদালতে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
পরে সেবায়েত ঋষিকেশ ভারতে চলে যান। যাওয়ার আগে নতুন সেবায়েত হিসেবে শংকর রায় নামে এক ব্যক্তিকে নিয়োজিত করে যান তিনি। বর্তমানে স্বত্ব¡মূলক মামলাটি লক্ষ্মীপুর জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এমতাবস্থায় লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক একেএম টিপু সুলতান সম্প্রতি জমিদার বাড়ি এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ওই স্থানে বসবাসকারী লোকজনকে ১৪ জুনের মধ্যে দখল ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেন বলে স্থানীয়রা জানান।
গত ৬ জুন রাতে গোবিন্দ জিউ মন্দিরের বিগ্রহ চুরির ঘটনা ঘটে। মন্দিরের সেবায়েত শংকর রায় জানান, ঘটনার তিন বিকালেও বিগ্রহ ছিল। পরদিন সকালে সেখানে গিয়ে মন্দিরের বিগ্রহের কিছু ভাঙা অংশ পাওয়া যায়। সাইনবোর্ডটিও নিয়ে গেছে। পরে মন্দিরের দরজায় আমাদের দেওয়া তালার ওপর আরও দুটি তালা লাগিয়ে যায় কে বা কারা।
এসব ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। মন্দিরের বিগ্রহ চুরি ও দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষার দাবিতে ১৮ জুন মানববন্ধন ও সমাবেশ করে তারা। এতে বক্তব্য রাখেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাজল দেবনাথ, এএলআরডি-এর নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে দালালবাজার জমিদার বাড়ির প্রায় ৩৬ একর দেবোত্তর সম্পত্তি দখলের পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতাই ওই বাড়ির গোবিন্দ জিউ মন্দিরের বিগ্রহ চুরি ও মন্দিরের দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পরে অতিথিরা দালালবাজার জমিদার বাড়ি পরিদর্শন করেন। তারা পৃথকভাবে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে বৈঠক করে মন্দির ও দেবোত্তর সম্পদ রক্ষায় সর্বসম্মত হন বলে জানান।
এই নিয়ে জানতে চাইলে বিদায়ী জেলা প্রশাসক একেএম টিপু সুলতান বলেন, প্রকৃতপক্ষে মোট সম্পত্তির অর্ধেক দেবোত্তর। তাও আদালতে বিচারাধীন। জমিদার বাড়ী সম্পূর্ণ অর্পিত ও লীজভূক্ত। লিজ নবায়ন না করায় ও অনুমতি ব্যতীত স্থাপনা করায় লীজ বাতিল করে আংশিক উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং বাকিদের ২/১ দিনের মধ্যে উচ্ছেদ করে পুরো সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে ও সংরক্ষণে থাকবে।কোন রাজনৈতিক ফায়দা লুটার সুযোগ নেই। দেবোত্তর সম্পত্তির বিষয়টি আদালতের সিদ্ধান্তের পর ব্যবস্থা নেয়া হবে। জমিদার বাড়ীটি পর্যটন কেন্দ্র করার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। কোন ব্যক্তিকে নতুনভাবে বসানো , বিগ্রহ চুরি কিংবা হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন ক্ষতির বিষয়টি গুজব ও ভিত্তিহীন।পরবর্তী যে জেলা প্রশাসক আসছেন তিনি এই ব্যাপারে সময়োপযোগী ব্যবস্হা নিবেন।
প্রতিবেদক:লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও দৈনিক আমাদের সময়
0Share