বায়ুরোধি প্যাকেটের গায়ে ফসলের লোভনীয় ছবি। লাবনী, টুনটুনি, গিরাকাটা, রুপবান, নলডোগ, পটিয়া, দিয়া, যাদু, রাজমনি বিভিন্ন ফসলের বীজের প্যাকেটের গায়ে লেখা এসব বাহারি নাম। শুধু নামটি লেখা বাংলায় বাকি সব তথ্যই ইংরেজি কিংবা চীনা ভাষায়। সব ফসলের বীজের প্যাকেটের গায়েই বড় করে লেখা আছে হাইব্রিড। লক্ষ্মীপুর জেলার মাসুদ বীজ ভান্ডারের আদনান সীড, রামগঞ্জের বাবুল বীজ ভান্ডার, রুহুল আমি বীজ ভান্ডারের আমিন সীড ব্র্যান্ডের কয়েকটি বীজের এমন বাহারি নাম।
প্যাকেট দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে, বীজের প্যাকেটগুলো বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রামেই প্যাকেটজাত করা হয়। চকচকে প্যাকেটিংয়ের পর উন্নতমানের বীজ হিসেবেই গ্রামগঞ্জের ছোট বড় অন্য বীজ বিক্রেতাদের হাত বদল হয়ে এসব বীজ সরাসরি চলে যাচ্ছে নিরক্ষর কৃষকদের ক্ষেতে।
বাহারি নাম আর ফসলের লোভনীয় ছবি দেখে আকাশচুম্মি দামেই বীজ কিনছে কৃষক। পরে প্যাকেটের ছবির সাথে ফলনের ছবির কোন মিল থাকেনা কিংবা কাংখিত চারা গজায় না। এমন অভিযোগ কৃষকদের। এভাবেই দীর্ঘদিন যাবত প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষক। এমন প্রতারণা দীর্ঘদিন চলে আসলেও লক্ষ্মীপুর জেলায় বীজ ব্যবসা মনিটরিং কিংবা মান যাচাইয়ের কোন উদ্যোগ নেই। কৃষকরা জানাচ্ছেন এটা বীজ ব্যবসার নামে অরাজকতা। এমন অবস্থা চলতে থাকায় স্বয়ং ক্ষুব্দ লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগও।
লক্ষ্মীপুরে বহু বছর যাবত বীজ মনিটরিংয়ের কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারী না থাকলেও আছে বীজ বিক্রয়ের ৪৫টি সনদপত্র।
লক্ষ্মীপুরের সদর, রামগঞ্জ, রায়পুর, রামগতি এবং কমলনগর উপজেলার বিভিন্ন বীজ বিক্রয় প্রতিষ্ঠান, কৃষক এবং কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
বীজ ব্যবসা নিয়ে কথা হয় জেলার বিভিন্ন উপজেলার ১০-১২ জন ক্ষুদ্র বীজ বিক্রেতার সাথে । এসময় সদর উপজেলার আবদুল মাজেদ এবং কমলনগরের রিয়াজসহ সবাই জানায়, দেশের বড় বড় নামি দামি কোম্পানীর দেখাদেখি লক্ষ্মীপুরের স্থানীয় কয়েকজন রাতারাতি বীজ প্যাকেটিং শুরু করে। এতে অল্প দিনেই তাদের ভাগ্য বদল হয়ে যায়। খোলা বীজ স্থানীয় বাজার ও দেশের বিভিন্ন স্থান হতে মণ (৪০ কেজি) হিসেবে কিনে এনে প্যাকেটে বাহারি নাম ও উচ্চ দাম বসিয়ে রাতের অন্ধকারে ঘরে বসে নিজেদের তৈরি প্যাকেটে প্যাকেটিং করে। পরে ছোট ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে কৃষকের হাতে তা তুলে দেয়।
তাদের কারোরই বীজ উৎপাদনের নিজস্ব খামার, পরীক্ষাগার, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বীজ আমদানির কোন প্রকার লাইসেন্স নেই। এধরনের প্রত্যেক ব্যবসায়ীর ছোট বড় বীজ দোকান আছে। তবে সে দোকানের নামে তাদের বীজের নাম থাকে না। নিজেদের বীজ হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন নামে। দোকানে দেশীয় বিভিন্ন বড় কোম্পানীর বীজ থাকে। কোন কৃষক যখন অন্য কোম্পানীর বীজ কিনতে চায় তখনই কৃষককে ভুল বুঝিয়ে নিজেদের ব্র্যান্ডের বীজ হাতে ধরিয়ে দেয়।
বীজ বিক্রেতা রিয়াজ জানায়, এ কাজটি করতে দোকানদারের আড়ালে তাদের লাগে একটা প্রত্যয়ন সনদপত্র। কষ্ট শুধু সনদপত্র টা আদায় করা। তারপর দেদারচ্ছে চলছে ব্যবসা। জেলা পর্যায়ে এ ব্যবসার কোন তদারকি নেই। তিনি আরো জানান, দুই বছর আগেও যিনি বাজারে বাজারে ফেরি করে তরকারি বিক্রয় করতেন তিনি এখন লক্ষ্মীপুর জেলার বড় বীজ কোম্পানী। অথচ তার একটি দোকান ছাড়া বীজ উৎপাদনের নিজস্ব খামার, পরীক্ষাগার, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বীজ আমদানির কোন প্রকার লাইসেন্স নেই।
সদর উপজেলার কৃষক কাউছার জানান, অবস্থা দেখে মনে হয় যে কেউই প্রত্যয়ন সদনটি নিয়ে স্থানীয় বাজার থেকে বীজ কিনে চকচকে প্যাকেটে ভরে ইন্টারনেট থেকে নেয়া ছবি আর বাহারি নাম দিয়ে উচ্চ মূল্যে বীজ বিক্রয় করতে পারে।
আবদুর রাজ্জাক জানান, কোন বীজের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে উল্টো কৃষককে শত প্রশ্ন ছুড়ে দেয় বীজ বিক্রেতারা। কিভাবে জমি চাষ করেছিলেন, মাটির মান কেমন ছিল, সার, কীটনাশক, নিড়ানী ঠিক মতো দিয়েছিলেন কিনা ? এমন সুচতুর প্রশ্ন এড়িয়ে চলতে কৃষক কোন প্রকার অভিযোগ তুলতে সাহস পায় না। তাছাড়া কৃষরা জানে না কার কাছে অভিযোগ করবে।
কমলনগর উপজেলার কৃষক মোস্তাফিজ জানান, তিনি গত মৌসুমে লক্ষ্মীপুরের মাসুদ বীজ ভান্ডার থেকে আদনান সীড নামক এক কোম্পানীর সীম পটিয়া নামক সীমের বীজ কিনে ২০ শতক জমিতে বপন করেছিলেন। কিন্ত প্রায় বিশ দিন পরেও কোন চারা গজায়নি। প্রতিটি ৫০ গ্রাম সীমের বীজের প্যাকেট তারা কিনেছেন ২শ ৩০ টাকা দরে। সে হিসেবে এক কেজির দাম পড়ে ৪ হাজার ৬শ টাকা। তিনি আরো জানান, স্থানীয় ভাবে তাদের এলাকায় প্যাকেট ছাড়া সীমের বীজ প্রতি কেজি বর্তমানে ১শ ২০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। মাসুদ বীজ ভান্ডার আদনান সীড নামে বীজ প্যাকেটিং করে দীর্ঘদিন যাবত বাজারজাত করছে।
সদর উপজেলার দত্তপাড়া এলাকার এক বীজ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, লক্ষ্মীপুরের স্থানীয় যে সকল কোম্পানী প্যাকেটিং করে বীজ বিক্রয় করছে তাদের কারোই হাইব্রিড বা উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদনের সক্ষমতা নেই। এরা বিভিন্ন স্থানীয় বীজের সাথে বিভিন্ন নামি দামি কোম্পানীর বীজ মিশ্রিত করে করে বাহারি নাম দিয়ে উচ্চ মূল্যে কৃষকদের নিকট বিক্রয় করছে।
লক্ষ্মীপুরের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে, লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের মাসুদ বীজ ভান্ডারের আদনান সীড, রামগঞ্জে বাবুল বীজ ভান্ডার, ভবানীগঞ্জ এলাকার রুহুল আমি বীজ ভান্ডারের আমিন সীড, নূর সীড অন্যতম। স্থানীয়ভাবে রাতারাতি কোম্পানী বনে যাওয়া এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ফসলের বীজের প্যাকেটের গায়ে তাদের নাম লেখা থাকলেও সরবরাহকারী বা আমদানী কারক প্রতিষ্ঠানের কোন নাম লেখা পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র একটি রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার লেখা রয়েছে। প্যাকেট খুলে দেখা যায় ভিতরে সাধারণ বীজ। দাম নামি দামি কোম্পানীর বীজের দামের চেয়ে অনেক বেশি।
বীজের স্থানীয় দোকানরা জানিয়েছেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সবজি, তেলবীজ, ধানসহ নানা রকমের শস্যবীজ সংগ্রহের পর সামান্য ধুয়ে মুছে কীটনাশক মেখে ছোট ছোট মাপে প্যাকেটে ঢুকিয়ে কৃষকের নিকট বিক্রি হচ্ছে খুবই উচ্চ মূল্যে। কৃষকরা জানে না যে এগুলো তাদেরই বীজ। অনেকেই এ বীজ কিনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষক।
এবিষয়ে জানতে চাইলে, আদনান সীড নামে বাজারে সরবরাহকারী লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের মাসুদ বীজ ভান্ডারের মালিক মাসুদ জানায়, তাদের একটা লাইসেন্স ছাড়া বীজ উৎপাদন খামার, পরীক্ষাগার ও কোন ধরনের কর্মকর্তা নেই। কিন্ত নিজেদের প্যাকেট করা বীজের গায়ে চীনা ও ইংরেজী ভাষা এবং হাইব্রিড কেন লিখছেন তার কোন উত্তর তিনি দিতে পারেননি। তারাও সব রকমের ফসলের বীজ প্যাকেট করে বাহারি নাম দিয়ে গায়ে হাইব্রিড লিখে বাজারজাত করছে।
আমিন সীডের ব্যবস্থাপক মো: দিদার হোসেন জানান, তারা বীজ উৎপাদন করে না, বিভিন্ন কোম্পানী ও কৃষকদের থেকে বীজ কিনে প্যাকেটজাত করে বিক্রয় করে। কিন্ত নাম রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে কোন উত্তর দিতে পারেন নি। তারা প্রায় সব রকমের ফসলে বীজ বিক্রয় করে।
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, বিএডিসি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত বীজ কেউ দোকানে বিক্রি করতে চাইলে সরকারি বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির প্রত্যয়নপত্র লাগে। এছাড়া কেউ নিজেদের উৎপাদিত বীজ বাজারে বিক্রয় করতে চাইলেও বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির প্রত্যয়নপত্র লাগে। প্রত্যয়নপত্র পাওয়ার আগে ও কোন বিশেষ বীজ বাজারে বিক্রি করার আগে বীজের মান যাচাই-বাচাই করার নিয়ম রয়েছে। কিন্ত লক্ষ্মীপুরে অন্য কোম্পানীর বীজ বিক্রয়ের সনদ নিয়ে নিজেরাই রাতারাতি কোম্পানী বনে যাওয়ায় বীজের কোন মান যাচাই করা হয় না। ফলে বীজে কৃষকদের পুঁজি হারিয়ে যাচ্ছে।
কৃষকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর শিশুপার্ক সংলগ্ন একটি ভাড়াবাড়িতে লক্ষ্মীপুর জেলা বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তার কার্যালয় রয়েছে। তবে গত ২ বছরের মধ্যে স্থানীয় কেউ ঐ অফিসের কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অফিসে আসতে কিংবা অফিস থেকে বের হতে দেখেননি। জেলা অফিস কর্মকর্তা ও মাঠ পর্যায়ে কোন ধরনের মনিটরিং না থাকলেও বীজ বিক্রয়ের জন্য জেলাব্যাপী অনেকগুলো লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। বীজ বিক্রয়ের লাইসেন্স নিয়ে দোকানদাররা নিজেরাই রাতারাতি ভেজাল বীজের কোম্পানী হয়ে যাচ্ছে।
এমন অভিযোগের ভিত্তিতে কথা হয় জেলা বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জহির আহমেদের সাথে। তিনি জানিয়েছেন, কয়েক বছর যাবত লক্ষ্মীপুরে এ পদে স্থায়ী কোন কর্মকর্তা ও কোন কর্মচারী নেই। তিনি নিজে ফেনী জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত। গত এক মাস আগে লক্ষ্মীপুর জেলার অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়েছেন। সে কারণে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান, এ কর্মকর্তা। তবে বাজারের খোলা বীজ কিনে প্যাকেটিং করে নাম দিয়ে বিক্রয় করাকে কঠিন অপরাধ বলে জানিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের লক্ষ্মীপুরের উপ-পরিচালক ড. মোঃ জাকির হোসেন জানান, লক্ষ্মীপুর জেলায় বীজ ব্যবসা নিয়ে যা হচ্ছে তা অরাজকতার সমান। তিনি কৃষক ও কৃষির স্বার্থে ভেজাল বীজ তৈরি ও বিক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন।
কৃষি সম্প্রারণ অফিস লক্ষ্মীপুর সূত্রে জানা যায়, বিএডিসি ও কৃষি মন্ত্রনালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত বীজ বিক্রয়ের জন্য লক্ষ্মীপুর জেলায় ৪৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বীজ বিক্রয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়াও জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে রয়েছে শতাধিক বীজ বিক্রয়ের দোকান।
0Share