করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনৈতিক একটা বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে এ ভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে দিনমজুর, রিকশা চালক, বিভিন্ন গাড়ির চালক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়লেও সচল ছিল গ্রামের কৃষকদের জীবিকা।
কিন্তু একটা পর্যায়ে করোনা ভাইরাসের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের জীবনেও। প্রতি বছরের ন্যায় যত্নে গড়া রবিশস্য উৎপাদন করে কৃষক স্বপ্ন বুনেছেন সন্তানদের মুখে দু’মুঠো ভাত ঠিক মতো তুলে দেবার। কিন্তু সে স্বপ্নে যেন এখন একেবারেই ভাটা পড়েছে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা লক্ষ্মীপুরের কৃষকরা এ সময়ে মূলত রবিশস্য উৎপাদন করে থাকেন। সয়াবিন, মরিচ, বাদাম এ মৌসুমে কৃষকদের প্রধান উৎপাদিত কৃষিপণ্য। জেলার সবর্ত্র চোখ ফেরালে মিলবে, মাঠজুড়ে সয়াবিন আর সয়াবিন। সারাদেশের মোট উৎপাদনের ৭০শতাংশ সয়াবিনের উৎপাদন হয় লক্ষ্মীপুর থেকে। যার কারণে জেলা ব্র্যান্ডিং এ জেলাকে সয়াল্যান্ড লক্ষ্মীপুর হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
অন্যদিকে সয়াবিনেে ফাঁকে ফাঁকে বেশি উৎপাদিত হয় মরিচ, তারপরের দখলটা বাদামের। ইতিমধ্যে কৃষকের ঘরে মরিচ উঠা শুরু হয়েছে। মরিচের হালতোলা পার হয়ে বেশ কয়েকটি বারও কৃষক মরিচ তুলেছেন। কিন্তু বাজারজাত না করতে পেরে চরম হতাশও হচ্ছেন তারা। চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে কেনা-বেচা বন্ধ হবার কারণে আয়-রোজগারের পথও বন্ধ হয়ে গেছে তাদের।
স্থানীয় ভুষিমালের ব্যবসায়ীরাও এ সব রবিশস্য কিনতে পারেন না অর্থ সংকটে। মোকাম থেকে টাকা না আসায় তাদেরও ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় মরিচ চাষী নুরুল ইসলাম(৬৭) বলেন, দোয়ান-টোয়ান সব কিছু বন্ধ অই গ্যাছে৷ আমরা মরিচ তুলি বাড়িতেই রাওন লাগে৷ বাজারেও তোলন যানা।
আর দোয়ানে নিয়া বেইছতেও হাইতান্ন। সংসার চলে না, কামাই-টামাই আর কোনডা করি না। বেরিগোতন টিয়া চাইলেও হেরা দেনা। কোন দিকে হাওলাত বরাতও পাই না। অন্যদিকে ক’কদিন পরেই ঘরে আসতে শুরু করবে সয়াবিনের ফসল। স্থানীয় কৃষকদের ধারণা, যেহেতু সয়াবিনের ফলন এসে গেছে। এ সয়াবিন পাকতে সময় লাগবে ১০দিন।
তারপরেই ঘরে উঠা শুরু করবে সয়াবিন। কিন্তু অতিবৃষ্টির কারণে নষ্ট হয়ে গেছে অধিকাংশ সয়াবিন। সয়াবিন পঁচে রীতিমত দুর্গন্ধও ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে। গত কয়েক বছর এ জেলার কৃষকরা সয়াবিন চাষ করে ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অতিবৃষ্টির কারণে জেলার ৬০শতাংশ সয়াবিনের ক্ষতি হয়েছে গত তিন বছরে।
সে ক্ষতি পুষিয়ে না আসতে আসতে এবার করোনা সংকট। যা কৃষকদের হতাশার বড় একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে জেলার এ রবিশস্য উৎপাদনকারী কৃষকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাবে। এতে পরবর্তী বছর থেকে কৃষকরা রবিশস্য উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।
জেলার কমলনগরের চর মার্টিন গ্রামে কৃষি ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ করছেন কৃষক আবদুল গণি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, কৃষিকাজ ছাড়াতো আমাদের আয়ের আর কোন পথ নাই। আমরা ধার-দেনা করে সয়াবিন করেছি, মরিচ করেছি। ক্ষেতে ঠিক মতো সার-ঔষুধ না দিলে ফসলও তেমন ভালো হবে না।
দেনার একটা বোঝা হলেও আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে নিচ্ছি৷ বাকিটা খোদার ইচ্ছা। যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় এবং যদি খরা হয়। আমরা এ ছাড়া চোখে মুখে অন্ধকার দেখি৷ সমস্ত মানুষের টাকা পয়সা এখন জমিতে। লাভের চেয়ে খরচের টাকা উঠবে কিনা, সেটা নিয়াও আমরা শঙ্কায় আছি।
আরেকজন সয়াবিন চাষী আবদুল হাদী(৬০)জানান, আমি আধ কানি জমিতে সয়াবিনের চাষ করেছি৷ সার-কীটনাশক হিসেব করলে মোট খরচ দাঁড়ায় ১৫হাজার টাকা। প্রতি বছরতো আমরা ঝড়-বৃষ্টির কারণে ফলন ঘরে তুলতে পারিনি৷ কিন্তু এবারতো আবার আরেকটা বিপদ। যদি ঝড়-বৃষ্টি আর করোনা একসাথে প্রভাব ফেলে, তবে আমাদের কোন পথ খোলা নাই। সরকারের কাছে অনুরোধ করবো, আমাদের সয়াবিন, মরিচ যেন সরকারিভাবে কেনা হয়৷ নইলে অনেক মানুষ ভাতে মরবে।
0Share