মিসু সাহা নিক্কন,রামগতি: স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের দণিাঞ্চল লক্ষ্মীপুরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক
নেতা-কর্মীর ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু অসহায় মেঘনার জেলেদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আজও হয়নি। জেলেদের আহরণ করা মাছ বিদেশে রপ্তানি করে যেসব ব্যবসায়ী কোটিপতি হয়েছেন, তারাও এদের ব্যাপারে উদাসীন। তারা একের পর এক ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন; কিন্তু মেঘনা পাড়ের জেলে পল্লীগুলো রয়ে গেছে আগের মতোই।
জেলেদের জীবন চলছে অনিশ্চয়তায়, কেননা মেঘনায় মাছ আহরণ করতে গেলে হঠাৎ করে জলদস্যুদের মুক্তিপনের দাবীতে জলদস্যুরা অপহরণ করা ও সর্বস্ত্র লুটে নেওয়া সহ নানবিধ সমস্যার শিকার হয়ে থাকেন। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থেমে নেই তারা, জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করে নদী থেকে সাগরে আসা-যাওয়া করেন মেঘনার জেলোরা। যখনই মহাজনের ডাক আসে তখনই নৌকা কিংবা ট্রলার নিয়ে ছোটেন নদীতে। ঘরে ফিরে আসার মনোবাসনা নিয়ে নদী থেকে সাগরে গেলেও অনেকেরই আর ফেরা হয় না।
লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন উপজেলাগুলোতে দাদন ব্যবসায়ীদের কোছে জিম্মি হয়ে পড়েছে মেঘনা পাড়ের হাজার হাজার মৎস্যজীবী। মহাজনদের খুশিমত বেধে দেওয়া দামে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে জেলেরা। দিন রাত হাড় খাটানির মাধ্যমে আহরিত মাছের লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হয় জেলেরা। মহাজনের দাদনের কাছে অসহায় জেলে পরিবার গুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাজার হাজার জেলে পরিবার বংশ পরস্পরায় নদীতে মাছ শিকার করে নিজেদের জীবন-জীবিকা চালিয়ে আসছে। মাছ আহরনই তাদের উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু বিগত কয়েক বছর যাবৎ নদীতে মাছ কম থাকায় জেলেদের জালে চাহিদানুরূপ হারে মাছ শিকার না হওয়ায় চরম হতাশা হয়ে পড়ছে জেলেরা।
আর এতে তাদের জীবন-জীবিকায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। জেলেরা মৌসুমের শুরুতে নৌকা মেরামত, জাল কেনার জন্য মহাজনদের কাছে আহরিত সকল মাছ বিক্রয় করার শর্তে টাকা ধার হিসেবে নেয়। নদীতে যখন মাছের অকালত্বে মহাজনদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় অধিকংশ জেলে বছরের পর বছর জিম্মি থেকে যায়। ফলে বিভিন্ন সময় আহরিত মাছের বাজার মূল্য থেকে অনেক কম মূল্যে জেলেদের মাছ বিক্রয় করতে বাধ্য করে মহাজনারা।
তাছাড়া নদীতে মাছ ধরতে গেলে জেলেদের নৌ-দস্যুদের কবলে পড়ে অনেক সময় চাঁদা প্রদান সহ সর্বস্ব দিতে হয়। অনেক সময় দস্যুদের হাতে জীবন পর্যন্ত চলে যায়। ইলিশ ধরার মৌসুমে দস্যুদের উৎপাত বেড়ে যায়, তার উপর মহাজনের বিশাল ঋণের বোঝা নিয়ে পানির দরে মাছ বিক্রয় করতে বাধ্য হয় মেঘনার জেলেরা।
লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় মৎস্য পেশার সাথে অর্থাৎ জেলের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার এরমধ্যে রামগতি উপজেলার ১৫,৯৩৯ জন, কমলনগর উপজেলার ১০,১০২ জন, রায়পুর উপজেলার ৫,৯৩৮ জন ও সদর উপজেলার ৪,৭৩৩ জন জেলেসহ সর্বমোট ৩৬,৭১২ জন জেলে মৎস্য দপ্তরে নিবন্ধিত রয়েছে। নদীর যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই সারিবদ্ধ ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের বহর দেখা যায়। শত শত সারিবদ্ধ ট্রলার ছুটে যাচ্ছে মাছ আহরনের আশায়। চাল-ডাল সঙ্গে নিয়ে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে চেপে হাজার হাজার জেলে নদীতে পর্যাপ্ত পরিমানে মাছ না পেয়ে যায় সাগর পাড়ে আর বহু জেলে হারিয়ে যায় গভীর বঙ্গোপসাগরে। বেতারবার্তায় যখন ঝড়ের আভাস পায় তখন আর তারা তীরে ফেরার সুযোগ পায় না। লাশ হতে হয় তাদের। দাফনের ভাগ্যও জোটে না। এদের বৌ-ছেলেমেয়েরা তীরে অপো করে দিন কাটায়। সাগরের বিশাল ঢেউয়ের শব্দে চাপা পড়ে যায় তাদের কান্না। প্রিয়জন হারানোর শোক ভুলে আবার নিজেরাই এ পেশা বেছে নেয় অভাবের তাড়নায়। পেশার পরিবর্তন হয় না তেমনি ভাগ্যও বদলায় না। মরে গেলে সাগর কিংবা নদীর তীরে তাদের সমাধি হয়। একসময় নদী ভাঙ্গনে হারিয়ে যায় তাদের সেই সমাধি টুকুও। বাপ-দাদার কবর জিয়ারতের সুযোগটি পর্যন্ত পায় না জেলেরা।
গবেষণায় জেলেদের জীবনযাপনের সার্বিক চিত্রে দেখা গেছে, যে সময়টুকু ইলিশের জাটকা ধরা বন্ধ থাকে সেই সময়ে ৯৯ দশমিক ৫২ শতাংশ জেলে ভিজিএফ এর চালের অপোয় থাকেন। ৩৭ শতাংশ জেলে বাকিতে খাবার কিনে খান আর ২৭ শতাংশ জেলে কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে জাটকা ধরেন। আবার এর মধ্যে ওই সময়ে সঞ্চয় ভেঙ্গে খাবার খান ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ জেলে আর ৬ শতাংশ জেলে টাকার অভাবে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দেন। তবে বিকল্প হিসাবে মাছের ব্যবসা করেন ৪ শতাংশ এবং আর বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত থাকেন আরো ২ শতাংশ জেলে।
গবেষণায় উঠে এসেছে অভাব থাকলেও জেলেদের অধিকাংশই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে চান না কিংবা যেতে চাইলেও যেতে পারেন না।
এনজিও ঋণ ও দাদন খুবলে খাচ্ছে জেলেদের :
এনজিওর ঋণ ও দাদন নামের অভিশাপ অথবা করুণার যাঁতাকলে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে উপকূলের জেলেদের জীবন। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত নদীতে ইলিশ থাকে না। আবার মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত উপকূলের মৎস্য অভয়ারণ্যগুলোতে ইলিশ শিকার বন্ধ থাকে। বছরের বিশাল ওই সময় জেলে পাড়াগুলোতে চলে দুর্দিন। এ সুযোগটি বেছে নেয় দাদন ব্যবসায়ী মহাজনরা। খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য এসময় চড়া সুদে এনজিওর কাছ থেকেও ঋণ নেয় জেলেরা। স্ত্রী-কন্যার মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে নিরুপায় জেলেরা এ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অপো করে মৌসুমের। জুন মাসের শুরুতে বর্ষা ও জোয়ারের পানি দেখে আশায় বুক বাঁধে জেলে পরিবারগুলো। অনেকের ৮/১০ বছরের শিশু পুত্র দিনরাত উপো করে বাঁচা-মরা লড়াইয়ে সামিল হয়। জালের ফাঁকে ইলিশ আটকালেও ভাগ্যের ফাঁক দিয়ে সেই ইলিশ চলে যায় মহাজনের মোকামে। ইলিশ ভর্তি জেলে নৌকা ঘাটে ভিড়ানোর সাথে সাথে বাজ পাখির মত ছোঁ মারে মহাজনের লোকেরা। দরদাম ঠিক হয় মহাজনের ইচ্ছানুযায়ী। প্রতিবাদের শক্তি নেই জেলেদের, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে। এনজিওদের ঋণ ইলিশ মৌসুমে সুদে-আসলে পরিশোধ না করলে খাটতে হয় জেল। মহাজনের দাদনের টাকা ও এনজিওদের চড়া সুদের ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে অনেক জেলে।
জলদস্যুদের তাণ্ডব :
মহাজন, বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের চেয়েও জেলেদের কাছে ভয়ংকর রুদ্রমূর্তি হচ্ছে জলদস্যু। ঝড়-বন্যার তবুও আলামত পাওয়া যায়, ডাকাতের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। হঠাৎ এসে এরা কেড়ে নেয় জেলেদের সর্বস্ব। আকাশে মেঘ নেই, গাঙ্গে বানের কিংবা তুফানের আলামত নেই। তবুও তার উৎকণ্ঠা। না জানি কখন হানা দেয়ে জলদস্যু। কেড়ে নেয় তাদের সবকিছু।
জেলেদের জাল, নৌকা এমনকি শিকার করা ইলিশ ও ট্রলারের ইঞ্জিন পর্যন্ত এরা খুলে নিয়ে যায়। কখনো কখনো জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়।
বিভিন্ন মহলের চাঁদাবাজি :
নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদাবাজদের হয়রানির শিকার হয় জেলেরা। মেঘনার বেশ কিছু পয়েন্টে বিভিন্ন হারে চাঁদা দিতে হয় জেলেদের। এমনকি কখনো কখনো পছন্দের মাছটি চাঁদাবাজদের তাদের হাতে তুলে দিতে হয়। মাছ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদাবাজদের চোখ লাল হয়ে যায় ! মেঘনা পাড়ের এক জেলের সাথে আলাপকালে তিনি জানান, যখন নদীতে ব্যাপক মাছ পড়ে তখন বিভিন্ন নৌকা থেকে পুলিশের নাম করে ২-৩টি করে মাছ দিতে হচ্ছে একশ্রেনীর দালালদের। একই অভিযোগ মেঘনার অনেক জেলেদের, যদি তাই হয় তাহলে এক কথায় বুঝতে হবে রকই ভক।
পরামর্শ হিসেবে সচেতন মহল জানান, নৌ নিরাপত্তায় কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরো বৃদ্ধি করে জেলেদের ওপর হামলা, লটুপাট, অপহরণ ও চাঁদাবাজি বন্ধ করার মাধ্যমে জেলেদের শোষণ ও জীবনের নিরাপত্তা পাবে। প্রতি বছরে নির্দিষ্ট একটা সময়ে জেলেদের আয়ের সব পথ বন্ধ থাকে। তখন তাদের শুধু চাল দিয়ে সহযোগিতা করে কোনো লাভ হয় না। এ কারণে তাদের বিকল্প পেশায় নিয়ে যাওয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। ইলিশ সংরণ প্রোগ্রাম নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কতজন জেলে মাছ ধরতে গেলেন আর ফিরে আসলেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায় না। এর ফলে অনেকে হারিয়ে গেলেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এছাড়া অনেকের মরদেহ না পাওয়া গেলে সরকারিভাবে তিপূরণও দেওয়া হয় না। এরকম নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে জেলেরা জীবনযাপন করছেন।
মেঘনার আকাল সময় ও নদীতে অভিযান চলাকালীন সময়ে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের বিষয়ে জেলা মৎস্য দপ্তর জানান, সরকারীভাবে নিবন্ধিত রামগতি, কমলনগর, রায়পুর ও সদর উপজেলায় ৩৬,৭১২ জন জেলে রয়েছে। এরমধ্য থেকে আগামী বছর হতে প্রতি উপজেলায় ৪৫০ জন জেলেকে বিকল্প কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
– See more at: http://www.sahos24.com/2014/12/25/19039#sthash.9UtG8z5Z.dpuf
0Share