“আমাদের স্থানীয় বাজারে যে মাছ বিক্রি হয়, তা ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করার চিন্তাও করা যায় না।”বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছের উৎপাদন দ্বিগুণ হওয়ায় তা রপ্তানির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে প্রশ্ন করা হলে এই উত্তর মেলে এক রপ্তানিকারকের কাছ থেকে।
জলাশয় থেকে মাছ তোলার পর সংরক্ষণের জন্য ফরমালিন ব্যবহারের স্বাস্থ্যঝুঁকি জানা থাকলেও এই ব্যবসায়ীর কথায় উঠে আসে ভিন্ন একটি সমস্যার কথা।
বাজারে ফরমালিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও মাছ চাষের সময় জলাশয়ে অ্যান্টিবায়োটিকসহ নানা ধরনের রাসায়নিক ব্যবহারের বিষয়টি এখনো রয়ে গেছে অনেকটাই আড়ালে, যার ইঙ্গিত মেলে ওই ব্যবসায়ীর কথায়।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেনও বললেন এই কথাটিই।
“আমরা শুধু ফরমালিন নিয়েই হৈ চৈ করছি। কিন্তু এর আড়ালে বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ যে ক্ষতি করছে, তার বিরুদ্ধে তেমন কিছু হচ্ছে না।”
এতে মানবদেহের কী ক্ষতি হতে পারে- জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এ সালাম জানালেন, এন্টিবায়োটিক ব্যবহৃত মাছ খেলে মানুষের কিডনি, যকৃৎ, হৃদপিণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং তা ক্যান্সারেরও ঝুঁকি তৈরি করে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের বিভিন্ন পুকুরে (অ্যাকুয়াকালচার) মাছের খাবারে ব্যবহৃত রাসায়নিক নিয়ে গবেষণা করে দেখেছে, খামারগুলোতে ১০টি ভিন্ন শ্রেণির এবং ৫০টি ভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়।
ব্যবহৃত রাসায়নিকের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াও রয়েছে দ্রুত বর্ধক ওষুধ, কীটনাশক ইত্যাদি।
খামারগুলোতে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করা হচ্ছে কার্প জাতীয় মাছ। এছাড়াও তেলাপিয়া, মাগুর ও পাঙ্গাসসহ আরো কয়েকটি জাতের মাছও চাষ হয়।
এসব মাছের খাবার হিসেবে কী ব্যবহৃত হচ্ছে, তা দেখার দায়িত্ব মৎস্য অধিদপ্তরের হলেও তারা তা দেখেন না বলে জানালেন অধ্যাপক সালাম।
অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিত্যরঞ্জন বিশ্বাস চাষ করা মাছে বিষাক্ত পদার্থের উপাদান (হেভি মেটালস) পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও জানালেন, অভ্যন্তরীণ বাজারে আনা মাছের পরীক্ষা হয় না।
“মাছ রপ্তানির সময় বিষাক্ত পদার্থের উপাদান (হেভি মেটালস) আছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে যেসব মাছ বিক্রি হয়, তার ক্ষেত্রে এ পরীক্ষা করা হয় না। কারণ এটা ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।”
অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়ায় ২০০৯ সালে ৮আট মাস ইউরোপে বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানি বন্ধ ছিল। তারপর নানা প্রচেষ্টায় মাছের খাবারের মান নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নত পরীক্ষার ব্যবস্থার পর অবস্থার উন্নতি হয়।
বিদেশিদের ঝুঁকিমুক্ত মাছ পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকলেও দেশের মানুষের জন্য জলাশয়ে উৎপাদিত মাছের ক্ষেত্রে পরীক্ষা যেমন হয় না, তেমনি আমদানি করা মাছের পরীক্ষাও হয় না।
বিদেশ থেকে বছরে প্রায় ৫০ হাজার টন মাছ আমদানি করা হয়। প্রধানত ভারত ও মিয়ানমার থেকে আনা এসব মাছ পরীক্ষা ছাড়াই বাজারে চলে আসছে বিক্রির জন্য।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তা নিত্যরঞ্জন বলেন, “আমদানি করা মাছের ক্ষেত্রে বিষাক্ত পদার্থের উপাদান (হেভি মেটালস) আছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয় না। শুধু কাস্টমস হাউজের চাহিদা অনুযায়ী ফরমালিন টেস্ট করা হয়।”
অথচ রপ্তানির ক্ষেত্রে হয় এর বিপরীত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যবসায়ী বলেন, “রপ্তানির জন্য মাছ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
“রপ্তানির আগে মাছের দেহে বিষাক্ত কোনো কিছুর উপস্থিতি আছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয়। বিষাক্ত উপাদান পাওয়া গেলে সেই মাছ রপ্তানির অযোগ্য হয়ে যায়।”
গত ১০ বছরে উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে বছরে প্রায় ৩৪ লাখ টন মাছ উৎপাদন করছে, যার প্রায় ৫০ শতাংশই হচ্ছে বদ্ধ জলাশয়ে খাবার দিয়ে চাষ করা মাছ।
গত অর্থবছরে প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন মাছ রপ্তানি হয়েছে, বাকিটা স্থানীয় ভোক্তারা ব্যবহার করছে এবং তা অনেকটাই স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে।
জনস্বাস্থ্যের এই ঝুঁকি এড়াতে মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের (বিসিএসআইআর)পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছেন ক্যাব সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তা নিত্যরঞ্জন বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার রোধে ‘গুড অ্যাকুয়াকালচার প্রাকটিস’ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
খামারিদের সচেতন করে তুলতে পারলেই নিষিদ্ধ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বন্ধ হবে বলে তার ধারণা।
মাছে ফরমালিন ব্যবহার প্রতিরোধে অধিদপ্তরের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার মধ্যেই সম্প্রতি একদল গবেষক রাজধানীর কারওয়ান বাজার পাইকারি মাছের আড়তে গিয়ে নদী, সমুদ্র ও চাষের ১৪ প্রকার মাছ পরীক্ষা করে আটটিতেই ফরমালিনের উপস্থিতি পেয়েছেন।
ফরমালিনের ব্যবহার থেকেও কিডনি ও যকৃৎ আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি ক্যান্সারের মতো রোগ সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি হয় বলে চিকিৎসকরা বলছেন।
তবে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদের দাবি, ঢাকা শহরের ৯৯ শতাংশ মাছই এখন ফরমালিনমুক্ত।
“মাছে ফরমালিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে গতবছর সারাদেশে ৮ হাজারের মত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে, জরিমানা করা হয়েছে ৪৩ লাখ টাকা। এখন ঢাকা শহরের ৯৯ ভাগ মাছ ফরমালিনমুক্ত।”
0Share