সান উল্লাহ সানু: ৪ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর হানাদার মুক্ত দিবস । এদিন মুক্তির আনন্দে মেতে উঠে পুরো লক্ষ্মীপুরবাসি। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা এ দেশিয় দোসর রাজাকার আল বদর সহায়তায় লক্ষ্মীপুর জেলায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ শেষে শত শত নিরীহ জনসাধারণকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। অপরদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতিরোধ্য গেরিলা যুদ্ধ তাদের জন্য আতঙ্কের কারণ ছিলো। লক্ষ্মীপুরের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জানান, মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার রফিকুল ইসলাম মাষ্টার, প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হায়দার চৌধুরী এবং সুবেদার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প।
মুক্তিযোদ্ধারা ১ ডিসেম্বর মিলেশিয়াদের বাগবাড়ী ক্যাম্প অনেক দূর থেকে ঘেরাও শুরু করে। প্রবল গুলি বর্ষণ করতে করতে উক্ত ঘাঁটির রাজাকার ও হানাদারদের অবরুদ্ধ রেখে ৩ ডিসেম্বর ঘাঁটির খুব কাছাকাছি ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের শাড়াঁশি আক্রমণের মুখে অসহায় হয়ে যায় তারা। ৪ ডিসেম্বর ভোরে হানাদাররা আত্মসমর্পন শেষে লক্ষ্মীপুর ছেড়ে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে লক্ষ্মীপুর হানাদার ও রাজাকার মুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ্মীপুরের নানা পরিসংখ্যান:
১৯৭১ সালের এই দিন ভোরে লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়িস্থ মিলেশিয়াদের প্রধান ঘাঁটি আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল গুলি বর্ষণের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ওই ঘাঁটির দুই শতাধিক রাজকার ও হানাদার সদস্য। এটাই ছিল লক্ষ্মীপুরে হানাদার বিরোধী মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ প্রতিরোধ। ৯ মাসে লক্ষ্মীপুরের রনাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধারা ৩৭টি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। এতে শহীদ হন ৩৫জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।এদের মধ্যে সদর উপজেলায় ২৩ জন, রামগতিতে ১ জন, কমলনগরে ২ জন, রায়পুরে ৭ জন ও রামগঞ্জে ২ জন শহীদ হন। এছাড়াও শতাধিক হানাদার সদস্য এবং ৫ শতাধিক রাজাকার নিহত হয়। এদের মধ্যে স্থানীয় বাগবাড়ি মাদাম ব্রিজের পাশে এক যুদ্ধে ৭০ পাকসেনা মারা যায়। জেলায় মোট শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১১৪। এ তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের সূত্রে জানা।
লক্ষ্মীপুরে হানাদারদের প্রবেশ:
একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে ও জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৭১ এর এপ্রিলের শেষ দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সর্বপ্রথম লক্ষ্মীপুর প্রবেশ করে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়ে মাদাম ব্রিজটি ভেঙে দেয়। হানাদর বাহিনী শহরে প্রবেশ করতে না পেরে মাদাম ব্রিজের নিচ দিয়ে নৌকায় করে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়।
১৯৭১ সালের ২১মে ভোর রাতে লক্ষ্মীপুর শহরের উত্তর ও দক্ষিণ মজুপুর গ্রামের হিন্দু পাড়ায় পাকহানাদার বাহিনী ভয়াবহ তান্ডবলীলা চালায়। বাড়ী ঘরে আগুন লাগিয়ে, বহু মানুষকে গুলি করে হত্যা করাসহ নানা ব্যভিচার চালায় তারা। এ সময় ১১টি বাড়ির ২৯টি বসত ঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে আগুনে দগ্ধ হয়ে ও হানাদারদের গুলিতে প্রাণ হারায় প্রায় ৪০জন নিরস্ত্র বাঙ্গালী। এসব নরকীয় হত্যাযজ্ঞের আজও নীরব সাক্ষী হয়ে আছে শহরের বাগবাড়ীস্থ গণকবর, মাদাম ব্রীজ, পিয়ারাপুর ব্রীজ ও মজুপুরের কয়েকটি হিন্দু ও মুসলমান বাড়ী।
গণহত্যার কলঙ্কিত স্থান:
লক্ষ্মীপুর শহরের মাদাম ব্রীজ, বাগবাড়ি গণকবর, দালাল বাজার গালর্স হাই স্কুল, মডেল হাই স্কুল, মদিন উল্যা চৌধুরী (বটু চৌধুরী) বাড়ি, পিয়ারাপুর বাজার, মান্দারী মসজিদ ও প্রতাপগঞ্জ হাই স্কুল, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা, এলএম হাই স্কুল ও ডাকাতিয়া নদীর ঘাট, রামগতির চর কলাকোপা মাদ্রাসা, ওয়াপদা বিল্ডিং, আলেকজান্ডার সিড গোডাউন, কমনগরের হাজিরহাট মসজিদ, করইতলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন গোডাউন, রামগঞ্জ গোডাউন এলাকা, রামগঞ্জ সরকারী হাই স্কুল, জিন্নাহ হল (জিয়া মার্কেট) ও ডাক বাংলো হানাদার ও রাজাকার ক্যাম্প এবং গণহত্যার কলঙ্কিত স্থান।
যুদ্ধ সংগঠিত হয়:
স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসে লক্ষ্মীপুর বেগমগঞ্জ সড়কে প্রতাপগঞ্জ হাই স্কুল, মান্দারী মসজিদ, মাদাম ঘাট ও বাগবাড়ি, লক্ষ্মীপুর-রামগঞ্জ সড়কে দালাল বাজার, কাজীর দিঘীর পাড়, কাফিলাতলী, পানপাড়া, মিরগঞ্জ, পদ্মা বাজার, মঠের পুল এবং রামগঞ্জের হাই স্কুল সড়ক ও আঙ্গারপাড়া, লক্ষ্মীপুর- রামগতি সড়কে চর কলাকোপার জমিদার হাট সংলগ্ন উত্তরে, করুণানগর, হাজির হাট আলেকজান্ডার এবং রামগতি থানা ও ওয়াপদা বিল্ডিং এলাকা, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা ও এল.এল হাই স্কুল এলাকায় অধিকাংশ যুদ্ধ সংগঠিত হয়।
যুদ্ধে শহীদরা:
৯ মাসের যুদ্ধে লক্ষ্মীপুরের বীর শহীদরা হলেন- মনসুর আহমেদ, রবীন্দ্র কুমার সাহা, আলী আজম, লোকমান মিয়া, জয়নাল আবেদিন, মোহাম্মদ হোসেন, আবদুল বাকির, জহিরুল ইসলাম, আহাম্মদ উল্যাহ, আবদুল মতিন, মাজহারুল মনির সবুজ, চাঁদ মিয়া, নায়েক আবুল হাশেম, মো: মোস্তফা মিয়া, নুর মোহাম্মদ, রুহুল আমিন, আবুল খায়ের, আবদুল হাই, মমিন উল্যা, আবু ছায়েদ, আব্দুল হালিম বাসু, এসএম কামাল, মিরাজ উল্যা, মোঃ আতিক উলাহ, মো. মোস্তফা, ইসমাইল মিয়া, আবদুল্যাহ, আবুল খায়ের ভুতা, সাহাদুলা মেম্বার, আবুল কালাম, মোস্তাফিজুর রহমান, বেনু মজুমদার, আলী মোহাম্মদ, শহীদ নজরুল ইসলাম, আবদুল রশিদ।
টর্চার সেল/বৈদ্যভূমি:
জানা যায়, যুদ্ধের নয় মাস শহরের বাগবাড়িস্থ বিশাল সারের গুদামটি ছিল লক্ষ্মীপুরে মিলেশিয়াদের প্রধান ঘাঁটি। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী স্থানীয় বাঙ্গালীদের ধরে এনে এখানে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। শেষে এদেরকে সন্নিকটস্থ রহমতখালী খালের উপর মাদামব্রীজে ফায়ার করে হত্যা করে খালে ভাসিয়ে দেয়া হতো লাশ। বাগবাড়ির এই জায়গাটিকে বলা হয় টর্চার সেল। যুদ্ধশেষে এই টর্চার সেল লাগোয়া গণকবর স্থাপিত হলেও সংরণ করা হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত মাদাম ব্রীজ এলাকা। ভগ্নদশা নিয়ে পরিত্যাক্ত মাদাম ব্রীজটি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের ত চিহৃ ও স্মৃতি নিয়ে আজও কালের স্বাী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই স্থানটি সংরণ না করে এখানে স্থাপিত হয়েছে গণশৌচাগার। এ নিয়ে নানান সমালোচনার ঝড় ওঠে লক্ষ্মীপুরবাসীর মাঝে। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর পৌর কর্তৃপ গণশৌচাগারটি ভেঙ্গে বৈদ্যভূমি হিসেবে সংরণ করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের নামে স্থাপনা:
নভেম্বরের শেষের দিকে রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসায় হানাদারদের ক্যাম্প আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। কমান্ডার হাবিলদার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে হানাদারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম বাসু শহীদ হন।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে লক্ষ্মীপুরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে তেমন কোন স্থাপনা গড়ে ওঠেনি। তবে শহীদ আব্দুল হালিম বাসু’র নিজ এলাকা সদর উপজেলার বাঙ্গাখাঁ ইউনিয়নের প্রধান সড়কটি তাঁর নামে নামাকরণ হলেও দীর্ঘদিন সংস্কার নেই সড়কটির। বিজয়র নগর এলাকায় তাঁর নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে “বাসু বাজার”।
সাবেক রামগতির স্মরনীয় যুবযোদ্ধা এখনকার কমলনগরের তোরাবগঞ্জ গ্রামের শহীদ আলী আহাম্মদ (ইপিআর)ও শহীদ মোস্তাফিজুর রহমান । তাদের নামানুসারে তোরাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে শহীদ আলী আহম্মদ ও মোস্তাফিজ অডিটোরিয়াম তৈরি করা এলাকাবাসির বহু দিনের দাবি।
২৩ সেপ্টেম্বর ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর একেএম আলী হায়দারের নেতৃত্বে তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালীর বাঁধের হাট এলাকার রাজগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন মাজহারুল মনির সবুজ।
তাঁর নামানুসারে তাঁর নিজ এলাকা ভবানীগঞ্জের পিয়ারাপুরে “শহীদ মাযহারুল মনির সুবজ উচ্চ বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে পারিবারিক উদ্যোগে এটি স্থাপিত হয়। পরে এমপিও ভুক্তি পেলেও বিদ্যালয়টির সার্বিক উন্নয়নে সরকারী বিশেষ কোন উদ্যোগ নেই বলে জানা যায়। রায়পুরে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করা হয়েছে কয়েকটি সড়ক।
প্রতি বছর ৪ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর মুক্ত দিবসে জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কামান্ড কাউন্সিল দিবসটি পালন করে।
0Share