রফিকুল ইসলাম মন্টু: ‘পাকসেনারা অবস্থান করেছিল সাইক্লোন শেলটারে। ভোররাতের দিকে সেই ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। গোলাগুলি অব্যাহত থাকে। এক পর্যায়ে পাকসেনারা নিরূপায় হয়ে পালানোর চেষ্টা করে। চারিদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশের এলাকা থেকে মানুষজন পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। অনেকেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়- একজন পাকসেনা ধরা পড়ে মুক্তিবাহিনীর হাতে। ওই অপারেশনে আমি মারাত্মকভাবে আহত হই।
আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৫টি গুলি লাগে। আমার বাঁচারই কথা নয়। এখন দ্বিতীয় জীবনে আছি।’ লক্ষ্মীপুরের রামগতির ওয়াপদা অপারেশন সম্পর্কে বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল রেজ্জাক চৌধুরী এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি অপারেশনের কথা তুলে তিনি বলেন, ‘আমরা ’৭১-এর অক্টোবর মাসের ১১ তারিখে আমরা অবস্থা নিয়েছিলাম লক্ষ্মীপুরের জমিদারহাটে। রফিক কমান্ডার ও তার বাহিনী রাজাকারদের নিয়ে কড়ইতোলা থেকে আলেকজান্ডার যাচ্ছিল। পথে জমিদারহাটের উত্তর পাশে মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে। মুক্তি বাহিনীর পাশে দাঁড়ায় মিত্র বাহিনী। সেদিন ৩৪জন রাজাকার ধরা পড়ে, উদ্ধার হয় ১৭টি রাইফেল।’
শুধু মক্তিযোদ্ধা রেজ্জাক চৌধুরীর এটুকু কথা নয়, লক্ষ্মীপুরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন স্থানে। ঐতিহাসিক সেই রহমতখালী খাল, মাদামব্রীজ, বাগানবাড়ি, বাগানবাড়ির কুরুয়ার চর আজও ভয়াল সেই দিনগুলোর সাক্ষ্য বহন করছে। লক্ষ্মীপুরে সেকালে ছিল এক বাগানবাড়ি। বর্তমানে সদর উপজেলা বিএডিসি গুদাম ঘর। এই গুদামঘরটি সেকালে রাজাকার, আলবদর ও পাকসেনাদের নির্যাতনের ঘাঁটি ছিল।
এখানে অসংখ্য শহীদ নারী-পুরুষকে ধরে এনে বর্বরোচিত নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। এরপর শহীদদের লাশ আশপাশের বাগানে বা গর্তে পুঁতে রাখা হতো। স্বাধীনতার পর এই গুদামঘরের পার্শবর্তী একটি মসজিদের পাশে কাদিরার বাড়ির বাগানে মানুষের অসংখ্য হাড়গোড় ও মাথার খুলি পাওয়া গেছে। জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার আনোয়ারুল হক মাষ্টারের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তৎকালীন বাগানবাড়ির উত্তর দিকে কুরুয়ার চর নামক একটি স্থান ছিল। স্বাধীনতার পর এখানকার একটি গভীর গর্ত থেকে ৭০টি লাশের হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। এখানেই তাদের সমাধিস্থল করা হয়েছে। একই সময়ে পার্শবর্তী শহীদ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মান করতে গিয়ে আরও ১০টি মানুষের মাথার খুলি পাওয়া যায়। রহমতখালী নদীটি লক্ষ্মীপুরের ইতিহাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। তখন এটি ছিল খরস্রোতা নদী। এই নদীর ওপর ছিল একটি ব্রীজ। ’
৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করতে বর্তমান লক্ষ্মীপুর সার্কিট হাউস সংলগ্ন রায়পুর-ঢাকা মহাসড়কের ব্রীজটি গ্রেনেড দিয়ে উড়িয়ে দেয় মুক্তিবাহিনী। কিন্তু তাতেও ক্ষান্ত হয়নি পাক হায়েনারা। এর পাশেই তারা তৈরি করে একটি বেইলি ব্রীজ। আলবদর রাজাকারেরা এতে সহায়তা করে। এদের সহায়তায় বিভিন্ন স্থান থেকে বহু নারী-পুরুষকে ধরে এনে এই ব্রীজের পাশে হত্যা করে ফেলে দেয়। ব্রীজের পাশে রহমতখালী নদীতে ভাসিয়ে দিত তাদের লাশ। এছাড়া প্রায় দু’ শহীদের লাশ ওই এলাকায় রাস্তার পাশে পুঁতে রাখে। স্থানটি পাকা প্রাচীর ঘিরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকার বাহিনীর হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনার নির্মম সাক্ষী হয়ে আছে লক্ষ্মীপুর জেলা। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধ ছিল তাদের জন্য আতংকের। লক্ষ্মীপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ছিলেন অ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামান চৌধুরী ও রফিকুর হায়দার চৌধুরী। লক্ষ্মীপুর শহরের মাদাম ব্রীজ, বাগবাড়ী গণকবর, দালাল বাজার গার্লস হাই স্কুল, মডেল হাই স্কুল, মদিন উল্যা চৌধুরী (বটু চৌধুরী) বাড়ী, পিয়ারাপুর বাজার, মান্দারী মসজিদ ও প্রতাপগঞ্জ হাই স্কুল, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা, এম.এম হাই স্কুল ও ডাকাতিয়া নদীর ঘাট, রামগতির চর কলাকোপা মাদ্রাসা, রামগতির ওয়াপদা বিল্ডিং, বর্তমান কমলনগরের করইতোলা, আলেকজান্ডার গোডাউন এলাকা, রামগঞ্জ সরকারী হাই স্কুল, জিন্নাহ হল (জিয়া মার্কেট) ও ডাক বাংলো হানাদার ও রাজাকার ক্যাম্প এবং গণহত্যার সাক্ষী হয়ে আছে। সূত্র বলছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে জেলার রামগতি, রায়পুর, রামগঞ্জ কমলনগর ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় অর্ধশতাধিক খন্ডযুদ্ধ হয়। এরমধ্যে রামগঞ্জ-মীরগঞ্জ সড়কে ১৭ বার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জেলায় ১৭টি বড় যুদ্ধসহ ২৯টি লড়াই হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া বিবরণ মতে, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক সেনাদের যুদ্ধ বাঁধে- প্রতাপগঞ্জ হাই স্কুল, মান্দারী মসজিদ, মাদাম ঘাট ও বাগবাড়ী, কালি বাজার, দালাল বাজার, কাজির দিঘীর পাড়, কাফিলাতলী, পানপাড়া, মিরগঞ্জ, পদ্মা বাজার, মঠের পুল এবং রামগঞ্জের হাই স্কুল সড়ক ও আঙ্গারপাড়া, লক্ষ্মীপুর রামগতি সড়কে চর কলাকোপার দক্ষিণে মিদার হাট সংলগ্ন সড়কে, করুণানগর, হাজিরহাট, আলেকজান্ডার এবং রামগতি থানা ও ওয়াপদা বিল্ডিং এলাকা, রায়পুর আলীয়া মাদ্রাসা ও এল. এম হাই স্কুল এলাকায়। লক্ষ্মীপুরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩৫জন মুক্তিযোদ্ধাসহ হাজার হাজার মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ শহীদ হন। মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয় শত শত হানাদার ও রাজাকার।
জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ’৭১-এর এপ্রিলের শেষ দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সর্বপ্রথম লক্ষ্মীপুর প্রবেশ করে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়ে মাদাম ব্রিজটি ভেঙে দেয়। পাকহানাদর বাহিনী শহরে প্রবেশ করতে না পেরে মাদাম ব্রিজের নিচ দিয়ে নৌকায় করে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। এদিকে মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মাস্টার রফিকুল হায়দার চৌধুরী ও অধ্যক্ষ মুনসুরুল হকের নেতৃত্বে অকুতোভয় কয়েকজন যুবক এ সময় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। তাদের কাছে ছিল ৫টি রাইফেল ও ৫টি গ্রেনেড। এরপর ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শফিক উল্যা, তোফায়েল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, হামদে রাব্বী, ফিরোজ আলমসহ কয়েকজন মাস্টার রফিকের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর জেলার বিভিন্ন স্থানে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ শুরু করেন। মে মাসের শেষদিকে পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধের পর বর্তমান কমলনগর উপজেলার লুধূয়া গ্রামের একটি পুকুরের কচুরিপানার ভেতর থেকে পাকসেনাদের ফেলে যাওয়া ১টি রকেট লাঞ্চার, ৭টি চাইনিজ রাইফেল, ১টি এলএমজি, ৭ হাজার গুলি উদ্ধার করা হয়। এ অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি যোগায়। তারা শত্রুদের বিরুদ্ধে আরো তীব্র শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে লক্ষ্মীপুর জেলার ৩৫জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এরা হলেন- লক্ষ্মীপুর সদর: আবু ছায়েদ, সোনাপুর; আবু হালিম বাসু, বাঙ্গাখাঁ; আব্দুল মতিন, বাঙ্গাখাঁ; রবীদ্র কুমার সাহা, ভবানীগঞ্জ; মাজহারুল মনির (সবুজ), আলীপুর; চাঁদ মিয়া, আলীপুর; মুনসুর আহম্মেদ, ছবিলপুর; আলী আজ্জম, নন্দনপুর; নায়েক আবুল হাসেম, সামাসপুর; মোঃ মোস্তা মিয়া, জামিরতলী; লোকমান মিয়া, জামিরতলী; জয়নাল আবেদীন, চররুহিতা; মোহাম্মদ হোসেন, ফতেধর্মপুর; এসএম কামাল, পালপাড়া; আবদুল বারেক, নরসিংহপুর; নুরু মোহাম্মদ, বড়ালিয়া; রুহুল আমিন, আটিয়াতলী; আবুল খায়ের, কাঞ্চন নগর; জহিরুল ইসলাম, সৈয়দপুর; আহাম্মদ উল্যা, উড়িষার কান্দি; সিরাজ, রায়পুর- মোঃ আতিক উল্যা, কেরোয়া; আব্দুল্লাহ, কেরোয়া; মোঃ মোস্তফা, উত্তর কেরোয়া; আবুল খায়ে ভুতা, চরমহোন্না; ইসমাইল মিয়া, উত্তর সাগরদি; সাহাদুল্লাহ মেম্বার, চরপাংগাসিয়া; আবুল কালাম, উত্তর সাইছা, রামগতি- মোস্তাফিজুর রহমান, তোরাবগঞ্জ; আলী আহম্মদ, তোরাবগঞ্জ; বেনু মজুমদার, চর জাঙ্গালিয়া; রামগঞ্জ- নজরুল ইসলাম, মাঝির গাঁ; আব্দুর রশিদ, কাঞ্চনপুর।
দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধের পর অবশেষে মুক্তি আলো এসে পড়ে লক্ষ্মীপুরের মানচিত্রে। লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়ির পশ্চিম দিক থেকে হাবিলদার আবদুল মতিন ও উত্তর দিক থেকে রফিক মাস্টারের নেতৃত্বে যুদ্ধ হচ্ছিল। এ সময় শতাধিক রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। ওরা ঘায়েল হয়। পাকসেনাদের পরাজয় ঘটে। সেই দিনটি ’৭১-এর ৪ ডিসেম্বর। মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে সেইদিনই হানাদার ও রাজাকার মুক্ত হয় লক্ষ্মীপুর জেলা। মুক্তিকামী জনতা উল্লাসে মেতে ওঠে। পরের দিন ৫ ডিসেম্বর এক নতুন সূর্য উদিত হয় লক্ষ্মীপুরের আকাশে।
তথ্যসূত্র: ১) বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন- লক্ষ্মীপুর জেলা; ২) মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর; ৩) লক্ষ্মীপুর ডায়েরী, সম্পাদনা-সানাউল্লাহ সানু।
লেখক: উপকূল বন্ধুখ্যাত সিনিয়র সাংবাদিক,
তিনি উপকূল সাংবাদিকতা এবং উপকূল দিবসের প্রবর্তক।
0Share