এক সময় লক্ষ্মীপুরসহ বৃহত্তম নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষের আতিথেয়তা সারাদেশে পরিচিত ছিল। কিন্ত অতীতের আতিথেয়তা বর্তমানে কোন কোন ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যধিতে পরিণত হয়েছে।বর্তমানে এটা নিয়ে সমাজের গরিব মানুষের দুর্দশার অন্ত নেই। কিন্ত তবুও থেমে নেই এ রীতি। বরঞ্চ কোন কোন ক্ষেত্রে অতীতের সকল পরিসংখ্যানকে অতিক্রম করে চলছে এ রীতি। ফলে বিষয়টি আতিথেয়তা ছেড়ে সামাজিক ব্যাধিতে রুপ নিয়েছে। কারণ প্রতি বছর এ রীতি পালন করতে গিয়ে অনেক গরিব মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না।
জেলার নানা ঐতিহ্যবাহী রীতি মধ্যে রমজান মাসে মেয়ের “জামাই বাড়িতে ইফতারী আর ঈদের সেমাই, চিনি” পাঠানো অঞ্চলের দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। বর্তমানে সে রেওয়াজ পালন করতে গিয়ে অনেক অভাবী মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছ। প্রতিনিয়ত ঘটছে নানা সামাজিক সমস্যা । তাই এ সমস্যাটি যাতে আর বৃদ্ধি না পায় সে জন্য এটা কে একটা সামাজিক ব্যধি মেনে নিয়ে এ সমস্যার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সভাপতি একেএম সালাহ উদ্দিন টিপু।
সালাহ উদ্দিন টিপু গত ১৭ মে তারিখে নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেন, “শ্বশুর বাড়ির ইফতার ও ঈদ উপঢৌকনকে না বলুন”। এরপর তার এ বক্তব্যকে সমর্থন করে স্ট্যাটাসটি লাইক করে ৮শ ৭১ জন, তাতে কমেন্টস করে ১শ ৩০ জন এবং শেয়ার করে ৪৭ জন। এ স্ট্যাটাস ছাড়াও সালাহ উদ্দিন টিপু এ বিষয়ে সিলেটের একটি নিউজ শেয়ার করেন।
সালাহ উদ্দিন টিপুর ওই স্ট্যাটাসের পর বিশেষ করে যুবকদের মাঝে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে গত ২০১৫ সাল থেকে লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর এ সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতি বছরই সংবাদ প্রকাশ করে আসছে।
একটি সামাজিক রীতি যেভাবে লক্ষ্মীপুরসহ সারাদেশে ব্যধিতে পরিণত হয়:-
স্থানীয় ভাবে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের শত বছরের নানা ঐতিহ্যের মাঝে অন্যতম একটি ঐতিহ্যের নাম ঈদ মৌসুমে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ইফতারী ও ঈদের সেমাই-চিনি পাঠানোর রীতি। যেটাকে এ অঞ্চলের স্থানীয়রা “জামাই বাড়ির ইফতারী ও ঈদের সেমাই, চিনি” নামেই জানেন।
শুধু যে মেয়ের বাড়িতেই দিতে হয় তা নয় অনেক জামাইও নিজ শ্বশুর বাড়িতে ও ইফতারি পাঠাচ্ছে আজকাল। তবে সে সংখ্যা খুবই নগণ্য। অন্যান্য রীতির ন্যায় যুগযুগ ধরে এ অঞ্চলের মুসলিম পরিবার গুলোতে এ রীতিও চলে আসছে । তবে ইদানিং এ রীতি নিয়েও নানা নৈতিবাচক কথা শুরু হয়েছে।
জেলার প্রবীন ব্যক্তির মধ্যে অন্যতম কমলনগর উপজেলার চর মার্টিন গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান (৯০) বলেন, রমজান মাসে জামাই বাড়িতে (মেয়ের শ্বশুর বাড়ি) ইফতারি দেওয়া লক্ষ্মীপুর তথা বৃহত্তর নোয়াখালীবাসির বহুল প্রচলিত একটি ঐতিহ্য। এখানে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে আম-কাঠাঁল ও ইফতারি দেয়ার রীতি আবহমান কাল ধরে চলে আসছে ।
তিনি বলেন, এ এলাকার জনপ্রিয় ইফতারী হচ্ছে মুরি, ছোলা, পিঁয়াজু, চপ, বেগুনী ও শাকের তৈরী বিভিন্ন ধরনের বড়া। আগেকার দিনে এ সকল ইফতারিই সরাসরি মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে পাঠানো হতো । তবে ইদানিং এভাবে আর না পাঠানো হয় না। এখন ইফতারী তৈরির সকল উপরকরণই স্বয়ং পাঠিয়ে দেওয়া হয় মেয়ের জামাই বাড়িতে। তার মতে, পরিবারের অবস্থা ভেদে সে ইফতার সামগ্রীর পরিমাণ হয় ভিন্ন।
চন্ত্রগঞ্জের গৃহবধূ স্বপ্না জানান, এ অঞ্চলে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ইফতারী দেওয়া হয় ২ বার। তবে কেউ কেউ ১ বারেই দিয়ে দেন।
১ম বার ইফতারি আইটেমের মধ্যে রয়েছে, ছোলা, মুড়ি, খেঁজুর, শরবত, নারিকেল, চিনি, সয়াবিন তৈল ইত্যাদি। এছাড়াও খেজুর, আপেল, আম ও থাকে। ১ থেকে ১০ রমজানের মধ্যেই প্রত্যেক মেয়ে পক্ষ জামাই বাড়িতে এ ইফতার সামগ্রী পাঠান। এ দফায় জামাই বাড়িতে এ সকল ইফতারি ঠেলাগাড়ি,বা রিক্সা করে নিয়ে যান কনের ছোট ভাই-বোন, ভাগিনা-ভাগনে, ভাই ঝি, দাদা-নানা, বাবা-চাচা, ভাই অথবা নিকট আত্মীয় যে কেউ।
অনেকে ইফতারী দেয়ার পূর্বে কৌশলে খবর নেন অন্য বেয়াইর (মেয়ের প্রকৃত পিতা) বাড়ি থেকে কোন ধরনের ও কি পরিমান ইফতারি এসেছে। স্বামী বা শ্বশুর-শ্বাশুরী ‘খিটখিটে মেজাজে’র হলে নয়া বউ ফোন করে গোপনে বাপের বাড়ীতে সংবাদ প্রেরণ করে যে- আর কিছু না হোক ইফতার সামগ্রী উন্নত ও পরিমাণে যেন বেশি হয়।
কারণ কোন কোন বর কিংবা বরের পিতাকে ইফতার সামগ্রী কম বা কিছুটা নিম্নমানের হলে রাগ করতেও দেখা যায়। সময়মতো ইফতারি দিতে না পারলে কোথাও কোথাও হালকা ঝগড়া-ঝাঁটি বা মনোমালিন্যও হচ্ছে।
এদিকে, মেয়ের বাড়ি থেকে যে ইফতারি নিয়ে যাওয়া হয় সেই ইফতারি মেয়ের জামাই’র পরিবার তাদের বাড়ি এবং পাড়া-পড়শীর প্রত্যেকের ঘরে ঘরে বিলি করেন। আর ইফতারের পরে মেজবানের ভূরিভোজের জন্য তাৎক্ষনিকভাবে জবাই করা হয় ঘরে পোষা বড় মোরগ বা মুরগী। তবে ইদানিং পোল্ট্রি মুরগীতে সব শেষ হয়।
২য় দফার সেমাই চিনিঃ
২য় দফা হলো রমজানের শেষ সপ্তাহ। ওই সময় মেয়ের জামাইর পরিবারের জন্য ঈদের কাপড়। সাথে থাকে হালকা ইফতারি ও সেমাই , চিনি। এ সময় মেয়ের জামাই’র বাড়ির সকলকে ঈদে বেড়াতে যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে আসা হয়।
মেজবানের ভূরিভোজের আয়োজন নিয়ে রয়েছে দারুণ সব ঘটনা।
মেজবানের ভূরিভোজের আয়োজনের বর্ণনা দিতে গিয়ে সদর উপজেলার কুশাখালীর মহসিন জানান, আগেকার দিনে পোল্ট্রি মুরগী পাওয়া যেত না। নিজের ঘরে পোষা মুরগী না থাকলে বা ধরতে ব্যর্থ হলে পার্শ্ববর্তী কোন ঘর থেকে মুরগী কিনে বা ধার করে আনা হতো ‘মান-ইজ্জত রক্ষার’ জন্য।
তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানান, মুরগী ধরার জন্য বাড়ির চটপটে কিশোর-কিশোরীদের কাজে লাগানো হতো। মেহমান যাতে মুরগীর কক্ কক্ শব্দ শুনতে না পান সেজন্য মুরগীর গলা চেপে ধরা হতো সতর্কতার সাথে ও তড়িগড়ি করে জবাই করা হতো মুরগি। একান্ত কোথাও মুরগী না পেলে বা ব্যর্থ হলে আন্ডা (ডিম) এনে ভুনা বা ভাজি করা হতো। মাছ দিয়ে মেহমানদেরকে খাওয়ালে বদনাম হতো বলেও জানান তিনি।
তার মতে, সেই আগেকার দিনের রেওয়াজ এখনো আছে এ অঞ্চলে। এখনো ইফতারি নিয়ে বাড়িতে মেহমান এলে ঘরের মোরগ-মুরগী জবাই করা হয়। মাছ দিয়ে মেহমানদের আপ্যায়ন করানোকে সম্মানহানিকর ভাবা হয়। কিন্তু এখন এ মেহমানদারীতে ও আসছে নানা পরিবর্তন।
0Share