লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে বঙ্গবন্ধুর আগমনের দিনে তাঁকে স্মরণ করে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল করা হয়েছে। রবিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত শেখের কিল্লা বাস্তবায়ন কমিটি। অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ গ্রহন করেন, শেখের কিল্লা বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মো. মাকসুদ আলম, সদস্য সচিব আবদুর জলিল, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডরপের প্রোগ্রাম ম্যানেজার আবদুল মালেক, চর পোড়া গাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সদস্য মোমিন উল্লাহ এবং মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেম প্রমুখ।
আয়োজকদের সূত্রে জানা যায়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে প্রত্যাবর্তনের পর দেশ গড়ার ডাক দেন। এর আগে তিনি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সনে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ২০ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম যে গ্রাম থেকে ‘দেশ গড়ার ডাক’ দিতে গেলেন সে গ্রামের নাম চর পোড়াগাছা। গ্রামটি বর্তমানে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায় অবস্থিত ।
লক্ষ্মীপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থ লক্ষ্মীপুর ডায়েরি সূত্রে জানা যায়
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি (রামগতির বাসিন্দা, বর্তমানে প্রয়াত-২৩/০১/২০১৮) মাহফুজুল বারীর কাছ থেকে নদী ভাঙন কবলিত ভূমিহীন পরিবারগুলোর দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে বঙ্গবন্ধু লক্ষ্মীপুরের রামগতি চরপোড়া গাছায় ছুটে আসেন। এটি সাবেক নোয়াখালী জেলাধীন রামগতি উপজেলার চর বাদাম ইউনিয়নের এক গ্রাম।
তিনি ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চর পোড়াগাছায় আসেন। তিনি ও তাঁর সফর সঙ্গীরা ২টি হেলিকপ্টার যোগে স্থানীয় বাগ্যারদোনা স্রোতহীন মেঘনা ঘেঁষে নতুন গড়ে উঠা চর কলাকোপা মৌজার চর পোড়াগাছা পৌঁছেন। সকাল ১০টায় হেলিকপ্টার থেকে বিশাল ব্যক্তিত্ব স্বপ্নমুখী বঙ্গবন্ধু নেমে আসেন। সেখানে তিনি একটি কিল্লায় দাড়িঁয়ে বক্তব্য দেন। জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘দেশ আমাদেরকেই গড়তে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে, প্রত্যেক বাড়িতে একটি করে লাউ গাছ হলেও লাগাতে হবে।
স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে দেশ গড়ার কাজ ও অর্থনৈতিক মুক্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে’। সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষে কোদাল হাতে নিয়ে স্বহস্তে মাটি কেটে ওড়াতে দিলেন। তিনি সেখানে মাটি কেটে স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করেন।
ওই দিন ২ কি:মি: ব্যাপী ওড়া কোদালসহ সোজা লাইন ধরে প্রায় ৪ (চার) হাজার স্বেচ্ছাকর্মী মুক্তিযোদ্ধা সমবায়ী যুবক গায়ে সাদা গেঞ্জি, পরণে প্যাঁচ দেওয়া লুঙ্গী গামছা পরে রাস্তা বরাবর একই সঙ্গে একই কমান্ডে ঢোল সহরতের তালে তালে মাটি কেটে রাস্তা বাঁধার কাজ শুরু করলেন যা যথাসময়েই শেষ হলো। যে গ্রাম কিল্লায় দাঁড়িয়ে প্রথম দেশ গড়ার ভাষণ দিলেন, যেখান থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে নিজ হাতে মাটি কেটে নোয়াখালী-রামগতি আঞ্চলিক সড়ক বাঁধার কাজ উদ্বোধন করলেন, সেই কিল্লাই আজ ‘শেখের কিল্লা’ নামে পরিচিত।
এই কিল্লাকে ঘিরে ও পাশেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম ‘গুচ্ছগ্রাম’ যা আজ সারা দেশে ঠিকানা, আদর্শগ্রাম-গুচ্ছগ্রাম-আশ্রয়ণ প্রকল্প নামে ভূমিহীন ছিন্নমূলদের জন্য স্থাপন করা হচ্ছে।
১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা ইউনিয়নে ৫৯০ একর জমিতে ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের জন্য গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু। ওই স্থানে তিনি নিজ হাতে কয়েক মুঠি মাটি ফেলে প্রকল্পের মাটি ভরাট কাজের সূচনা করেন। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে মাটি ভরাটকৃত স্থানটি ‘শেখের কেল্লা’ হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিতি পায়। এ প্রকল্পে দুইশ’ ভূমিহীন পরিবারের প্রত্যেককে আড়াই একর ও দশ পরিবারের প্রত্যেককে ৩০ শতাংশ করে জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। পরে ১৯৭২-৭৪ সালে বরাদ্দ পাওয়া পরিবারগুলো এ স্থানে তাদের বসতি গড়েন।
সাবেক রামগতি উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ জানান, ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনিও কয়েক হাজার মানুষের মতো গুচ্ছগ্রামে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলেন। ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর লক্ষ্মীপুরের এ গুচ্ছ গ্রামেই প্রথম সফর করেন বঙ্গবন্ধু।
অন্যদিকে: ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত শেখের কিল্লা স্থানটি পরিদর্শন করেন। তখন সর্বসম্মতিক্রমে জাতির পিতার স্মৃতি রক্ষায় সেখানে শেখের কিল্লার পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা নামকরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর পদধূলি পড়ার সঠিক স্থানটি চিহ্নিত করে ‘বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা স্মৃতি স্তম্ভ’ নির্মাণের আশ্বাস দেন। বর্তমানে সেখানে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ হচ্ছে।
চর পোড়াগাছায় বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেদিনের বক্তব্য শুনেছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডর্প’র প্রতিষ্ঠাতা ও গুসি আর্ন্তজাতিক পুরষ্কার বিজয়ী এএইচএম নোমান। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, কিল্লার স্থানে একটি স্মৃতি স্তম্ভ, পর্যটক রেস্ট হাউজ, স্থানীয় সংস্কৃতি, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইতিহাসসহ পাঠাগার সম্বলিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা স্বপ্ন কমপ্লেক্স’ স্থাপন অত্যন্ত প্রয়োজন। এতে স্থানটির গুরুত্ব বাড়বে এবং মেঘনার নদীসহ একটি পর্যটন এলাকা গড়ে উঠবে।
0Share