লক্ষ্মীপুর টুয়েন্টিফোর ডটকম: কালের আর্বতনে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলো। তেমনি গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্প আজ হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের ঘরে এখন আর এগুলো আগের মত চোখে পড়ে না। ভোরে আজানের সাথে সাথে স্থদ্ধতা ভেঙ্গে ঢেঁকির শব্দ এখন আর ছড়িয়ে পড়েনা চারিদিগে।
চোখে পড়ে না বিয়ে সাদির উৎসবে ঢেঁকি ছাটা চালের ক্ষির পায়েস রান্না। অথচ একদিন গ্রাম ছাড়া ঢেঁকি কিংবা ঢেঁকি ছাড়া গ্রাম কল্পনা করাও কঠিন ছিল। যেখানে বসতি সেখানেই ঢেঁকি কিন্তু আজ তা আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য থেকে মুছে যাচ্ছে।
এই গ্রাম বাংলার ঢেঁকি নিয়ে কবি – সাহিত্যিক রচনা করেছেন কবিতা গল্প। বাউলরা গেয়েছেন গান। আগে গ্রামের প্রায় বাড়িতেই ঢেঁকিতে ধান ভানতো। জীবিকা অর্জনের মাধ্যম ও ছিল। এটা পূর্বের তুলনায় তা আজ দেখা যায় না। অনেকই এ পেশায় জড়িত ছিল। বর্তমানে তারা পেশাচ্যুত। তাদের অনেকেই এখন কষ্টে দিনাতিপাত করছে। এই পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকদের বলা হয় তারানী।
আগে ঢেঁকি শিল্পে জড়িত ছিল অনেকে। এরা সবাই বাধ্য হয়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। কেউ কাঁথা সেলাই কেউবা দর্জির কাজ করেন, আবার কেউ কেউ ভিক্ষা বৃওি ও ঝি-এর কাজ করছে। করছে হাঁস- মুরগী পালন। গ্রামের লোকেরা এখন আর আগের মতো ঢেঁকিতে ধান ছাটাই করে না। প্রায় গ্রামে মিনি রাইস মিল গড়ে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েরা এখন লেখাপড়া শিখছে।
তাই বড়দের এখন কেউ ঢেঁকিতে পাড় দিতে দেয় না। তা ছাড়া মেয়েরা যদি একটু লেখাপড়া জানে তবে শ্বশুর বাড়ি এসে ঢেঁকিতে পাড় দিতে ধান ভানতে চায় না। সেজন্য গ্রামে এখন ঢেঁকি দেখা যায় না। গ্রাম-গঞ্জেএখন শত শত মিনি রাইস মিল গড়ে উঠেছে। মানুষ শিক্ষিত হয়েছে। রুচি ও গেছে বদলে। ফলে ঢেঁকি অস্তিত্ব আজ বিলুপ্তির দ্বার প্রান্ত প্রায়। হাজার হাজার বিধবা তালাক প্রাপ্ত এবং গরীব মহিলাদের জীবিকা অর্জনের একমাত্র সম্বল ছিল এই ঢেঁকি। গ্রামে গেলে কারো কারো বাড়িতে ঢেঁকি দেখা যায়।
কিন্তু এতে এখন আর ধান ভানা হয় না। গোয়াল ঘরে কিংবা অন্য কোথাও পরিত্যক্ত রয়েছে। হয়তো এমন একদিন আসবে যখন ঢেঁকি দেখার জন্য হয়তো বা যাদুঘরে যেতে হবে। বুঝাতে হবে কিভাবে ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গানো হত। সভ্যতার প্রয়োজনে ঢেঁকির আর্বিভাব ঘটেছিল। আবার গতিময় সভ্যতার যাত্রা প্রযুক্তিগত উৎকষই ঢেঁকি বিলুপ্তি করে দিয়েছে। একে না মেনে উপায় নেই।
মহিলারা সংসারে শত অভাব অনটনের ভিতরে ও নিজেদের ক্লান্তি ঢাকার জন্য ঢেঁকির তালে তালে গান গেয়ে ধান ছাঁটাইয়ের কাজ করতো। এক দশক আগেও গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ঢেঁকি চোখে পড়ত। গৃহস্থের বাড়িতে একাধিক ঢেঁকি থাকতো ঘরের পাশে বাড়তি একটি চাল দিয়ে তৈরি করা হত ঢেঁকি রাখার ঘর। গ্রামের মহিলাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো কে কত ভোরে উঠে ঢেঁকিতে পা দিতে পারবে।
এবং কে কত বেশি ধান ছাঁটাই করতে পারে। কৃষক বধূর ঢেঁকির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেতো কৃষকের। কৃষক লাঙ্গল কাধে গর্ব নিয়ে ছুটতেন মাঠ পানে। গৃহিনী হাঁস- মুরগী ছেড়ে দিতেন। এগুলো ছুটে যেতো ঢেঁকিশালার দিকে খাদ্যের সন্ধানে। ভারানীদের তাড়া খেয়ে কক শব্দ করতে করতে পালাতো সেখান থেকে। ধান ভানার সময় মহিলাদের হাতের চুরির ঝনঝন শব্দ হত।
শব্দ হতো পায়ের নুপুরের সব মিলিয়ে সৃষ্টি হতো এক সঙ্গীত মুখোর পরিবেশ। ঢেঁকি কাঠের তৈরি। কুল, বাবলা, জান, গাব ইত্যাদি কাঠ দিয়ে ঢেঁকি তৈরি করাহতো। সাড়ে তিন থেকে চার হাত দৈর্ঘ্য এবং পৌনে এক হাত চওড়া। মাথার দিকে একটু পুরু এবং অগ্রভাগ সরু এর মাথায় এক হাত লম্বা একটি কাঠের থক্তা থাকে। একে বলে রেনু বা ছিয়া। এর মাথায় লাগানো থাকে লোহার গোলা। গোলার মুখ যে স্থানটি মাটি স্পর্শ করে তাকে বলে গড়। এটা চার পাঁচ ইঞ্চি গর্ত। গর্তের ভিতরে স্থাপিতহয় কাঠের একটি অংশ।
অনেক কাঠের পরির্বতে পাথর খন্ড ব্যবহার করেন। তবে যাই ব্যবহার করা হোক না কেন সেটি হয় খুব মসৃন এই গর্তের ভেতর দেয়া হয় ধান। ঢেঁকির পেছনে ঢেঁকিতে ধান ভানতে সাধারণ দু’জন লোকের প্রয়োজন। একজন ঢেঁকিতে ধান দেয় গাড়ের (গর্তের) ভিতর ধান নাড়াচাড়া করে। একজন পাড় দেয়। অনেক সময় বেশি ধান হচ্ছে তা দু’জনের দ্বারা হয়ে উঠে না, তখন তিনজন লাগে। দু’জন দু’জন একসাথে পাড় দেয়। একজনে ধান উল্ট পালট করে দেয়।
এভাবে কয়েকবার ধান পাড় দিয়ে খোসা আলাদা করার পর কুলো দিয়ে ধান পরিস্কার করতে হয়। তখন বের হয় চাল। এতে যথেষ্ট পরিশ্রমও বটে। নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে ঢেঁকি হয়তো অপরিচিত। ঢেঁকির নাম শুনেছেন অনেকেই কিন্তু চোখে দেখেননি। এমন লোকও আছে। আমাদের গানেও প্রবাদে অনেকবার ঢেঁকির কথা এসেছে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত গান রচনা করেছেন।
পায়ের পরশে পেয়েছে কাঠের ঢেঁকির প্রাণ। তাছাড়া ঢেঁকি নিয়ে যে প্রবাদ আছে তা আমরা অহরহ ব্যবহার করি। ,যেমন অনুরোধে ঢেঁকি গেলা। অসম্ভব কোন কাজ সম্পাদন করার ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার হয়। অপদার্থের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় আমরা কাঠের ঢেঁকি। ঢেঁকি শিল্পের শব্দের প্রতিধবনি গ্রাম বাংলার চিহ্নিত হয়ে উঠে ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে।
0Share