সানা উল্লাহ সানু | লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর মতিরহাট মাছ ঘাট, বাত্তিরখাল ঘাট, সেন্ট্রারখাল ঘাট, রামগতি বাজার মাছ ঘাট। শনিবার সকাল থেকে বিকেলে পর্যন্ত এ ঘাটের চেহারা ছিল অন্যান্য দিনের তুলনায় ভিন্ন। জেলেরা একটার পর একটা নৌকা ঘাটে নিয়ে আসছে। অনেক নৌকা সাজসজ্জায় ভরপুর নৌকা। রঙ-বেরঙের কাগজে সাজানো নৌকায় বাজছে গান। কোথাও রান্না হচ্ছে পোলাও-মাংস, কোথাও আতশবাজির ধ্বনি। জেলেরা নতুন জামা-কাপড় পরে প্রস্তুত হচ্ছেন বাড়ি ফেরার। যেন এক আনন্দমুখর উৎসব।
এ উৎসবের পেছনে রয়েছে এক ভিন্ন গল্প। শুক্রবার (৩ অক্টোবর) মধ্য রাত থেকেই শুরু হয়েছিল ২২ দিনের মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা। এ বিরতিকে এখন জেলেরা আনন্দঘন ‘বিদায় উৎসব’ হিসেবেই পালন করে থাকেন।
নদীতে শেষ দিনটা আনন্দে কাটালাম
কমলনগর উপজেলার মাতব্বরহাট মাছ ঘাটে কথা হয় জেলে আকরাম, সৈয়দ আহমদ ও মালেকের সাথে। তারা বলেন, “প্রায় ৪ মাস নদীতে মাছ ধরেছি। এখন ২২ দিনের ছুটি। মৌসুমের শেষ দিনটায় নৌকা সাজিয়ে ঘুরেছি, পোলাও-মাংস রান্না করেছি। সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া আর হাসি-তামাশা হয়েছে।”
শুধু খাওয়া-দাওয়া নয়, মহাজনরা জেলেদের নতুন লুঙ্গি, তাদের স্ত্রীদের জন্য শাড়ি এবং কিছু মাছ এবং মিষ্টি দিয়ে বাড়ি পাঠাচ্ছেন।
হালখাতার প্রস্তুতি
সেন্টারখাল মাছ ঘাটের জেলে কবির হোসেন জানান, “আজ জেলেদের বিদায় উৎসব। কাল থেকে শুরু হবে ব্যবসায়ীদের হালখাতা।” তিনি আরো বলেন, গত কয়েক মাস তেলের দোকান, জালের দোকান, মুদি ও চা দোকান থেকে জেলেরা ধার নিয়েছিলেন। বন্ধের সময়ে সবাইকে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই ঋণ শোধ হবে। সাথে চলবে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন বিরিয়ানি, পোলাও, খিচুড়ি, জিলাপি।
ঘাটের ব্যবসায়ী মেহেদী বলেন, “হালখাতার দিন সবাই এসে টাকা পরিশোধ করবে। তখন দোকানদার আর জেলেরা মিলে খাওয়া-দাওয়াও হয়।” অনেকে জেলেদেরকে সামান্য পুরস্কারও দেয়।
লাভের বদলে ক্ষতি
আলেকজান্ডার ঘাটের নৌকার মহাজন কামাল ভান্ডারী জানান, এই মৌসুমে তার আয়-ব্যয় ছিল হতাশাজনক। “জাল ও নৌকায় খরচ হয়েছে সাড়ে ৮ লাখ টাকা। আয় হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ। এখনো ক্ষতিতে রয়েছি। তবুও জেলেদেরকে লুঙ্গি গামছা, শাড়ি এবং মিষ্টি দিয়েছি। তারা গরিব মানুষ এতেই অনেক খুশি হয়েছেন। কিন্ত আনন্দের মাঝেও জেলেদের মাথায় চিন্তা ঋণের বোঝা কিভাবে শোধ হবে ?
ঘাটে ঘাটে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভীড়
শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত লক্ষ্মীপুরের ৫টি ইলিশ বিক্রির ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে প্রতিটি ঘাটে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভীড়। নদী থেকে আড়তে ইলিশ উঠার সাথে সাথেই ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে কেনার জন্য । বেলা ১১টায় মাতব্বরহাটে কথা হয় ক্রেতা ও স্কুল শিক্ষক নুর নবীর সাথে। তিনি বলেন, ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে তাই কিছু কিনে বাড়িতে রাখবো সে কারণে ঘাটে এসেছি। তিনি আরো বলেন, এসময়ে নদীর ইলিশ সবচেয়ে সুস্বাদু তাই সবাই এসময়ে বেশি ইলিশ কিনে।
জেলেদের অবসরের দিনগুলো
৫৫ বছরের জেলে আবু আহম্মদ জানান, “প্রথম কয়েকদিন বাড়িতে আরাম করি। পরে জাল, নৌকা মেরামত করি, আত্মীয়ের বাড়ি যাই। এ সময় জেলেপাড়ায় বিয়ে-শাদীর আয়োজনও হয়। তবে জেলে মিজান, মনোয়ার বলেছে, এ ২২ দিনের এ অবসর মানে অনেকের বাড়িতে চুলায় আগুন না জ্বলার আশঙ্কা।
প্রথম দিন থেকেই খাদ্য সহায়তা চায় জেলেরা
মতিরহাট, মাতব্বরহাট ও সেন্টারখাল ঘাটের ৬-৭ জন জেলের সাথে কথা বলার সময় সকল জেলেই জানিয়েছেন ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিন থেকেই জেলেদের খাদ্য সহায়তা দেয়া যেন শুরু করা হয়। তখন জেলেদের আর তেমন কষ্ট হবে না।
বাস্তবতা বনাম উৎসব
জেলেরা বলছেন, নদীতে মাছ ধরা বন্ধ হওয়ায় একদিকে যেমন তারা আনন্দঘন বিদায় উৎসব পালন করছেন, অন্যদিকে ঋণের বোঝায় দিশেহারা। আনন্দ-হাসির মাঝেই তাদের জীবনে লুকিয়ে আছে অনিশ্চয়তা।
অক্টোবরের ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ কেন ?
মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক সিনিয়র সহকারী পরিচালক সুনীল ঘোষ জানায়, ইলিশ মাছ ডিম ছাড়ার সাথে পূর্ণিমা ও আমাবশ্যার সর্ম্পক রয়েছে। এটা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত। বাংলা আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে এবং পরে ও আমাবশ্যার আগে পরে ইলিশ মাছ সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে। চলতি বছর ৬-৭ অক্টোবর পূর্নিমা হবে। এবং ২০-২১ অক্টোবর আমাবশ্যার হবে। তাই এসময়ের ৩ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ২৫ অক্টোবর মধ্যরাত পর্যন্ত মোট ২২ দিন মা ইলিশ রক্ষায় মেঘনাসহ অন্যান্য নদীতে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে।
ইলিশ মাছ কতটি ডিম ছাড়ে ?
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট র তথ্য মতে, একটি পরিপক্ক ইলিশ সাধারণত ১৫ থেকে ১৮ লাখ (১.৫–১.৮ মিলিয়ন) ডিম ছাড়ে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই সংখ্যা কমে এসে ৮ থেকে ১২ লাখ–এ নেমে এসেছে।
ইলিশ কোন নদীতে ডিম ছাড়ে ?
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য অফিসের দেয়া তথ্যমতে, লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার সেন্টারখাল থেকে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল ইউনিয়ন পর্যন্ত মোট ১০০ কিলোমিটার এলাকাকে মৎস্য বিভাগ ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছিল।
অন্যদিকে ভোলা জেলার মেঘনা নদীর শাহবাজপুর শাখার ৯০ কিমি, তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিমি, পটুয়াখালী জেলার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিমি, শরীয়তপুর জেলার নিম্ন পদ্মার ২০ কিমি, বরিশাল জেলার গজারিয়া ও মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকা ইলিশের অভয়াশ্রম। এসব এলাকায় ইলিশ ডিম ছাড়ে এবং বড় হয়। নিষেধাজ্ঞার সময় এসব এলাকায় সব রকমের ইলিশ সংরক্ষণ, আহরণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও মজুদকরণ নিষিদ্ধ রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত মৎস্য বিভাগ, জেলা-উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে প্রতিদিন নদীতে অভিযান পরিচালনা করবে। এসময় লক্ষ্মীপুর জেলায় ৫২ হাজার জেলের মধ্যে নিবন্ধিত ৪৩ হাজার ৩০০ জেলেকে ২৫ কেজি করে খাদ্য সরবরাহ করা হবে।
জেলা প্রশাসক রাজিব কুমার সরকার বলেন, ইতোমধ্যে বরাদ্ধকৃত ভিজিএফের চাল জেলেদের মধ্যে বিতরণ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক জেলেকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, যারা আইন অমান্য করবে, তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জেল-জরিমানা করা হবে। এটি বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার।
0Share