মিসু সাহা নিক্কন, নিজস্ব প্রতিবেদক:: সেবালয়, আপনালয়, তথ্যালয়, ক্ষণিকালয়, রসালয় প্রভৃতি শব্দগুচ্ছ কোনো অভিধান থেকে নেয়া নয়, একটি গল্প থেকে নেয়া যার রচয়িতা একজন সহকারী কমিশনার (ভূমি)। জংলা, অপরিস্কার, জীর্ণ ও মধ্যশ্রেণীর দৌরাত্ম্য নির্ভর ভূমি অফিসের আমূল পরিবর্তনের নায়ক রামগতি উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) তথা এসি ল্যান্ড মোঃ রবিউল হাসান।
১৯৩৫ সনে রেভিনিউ অফিস ও পরবর্তীতে উপজেলা ভূমি অফিস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এ ঐতিহ্যবাহী অফিসটিতে নিয়মিত এসি ল্যান্ড পদায়ন করা হয়নি ফলে অব্যবস্থাপনার মারাত্মক শিকারে পরিণত হওয়া এ অফিসে ছিল দালালদের দৌরাত্ম্য। ছিল না কোন রেকর্ডরুম ফলে নদীভাঙ্গা ও সর্বোচ্চ আশ্রয়ণ প্রকল্পভুক্ত এ এলাকায় রয়েছে সত্তর বছরেরও পুরাতন রেকর্ডপত্রাদি যা উই পোকায় খেয়ে আর পানিতে ভিজে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। মূল অফিসটি ছিল বনজ গাছে ঘেরা জংলা পরিবেশে আর আগাছায় ভরা ছিল চারপাশ। বর্তমান এসি ল্যান্ড এসে যা করলেন তা যেমন অকল্পনীয় তেমনি এক ইতিহাস। উনি প্রথমে হাত দিলেন রেকর্ডরুম গড়ার কাজে। নিজস্ব কিছু তহবিল আর অফিসের পুকুরের মাছ বিক্রি করে পুরাতন জীর্ণ-শীর্ণ টিনের ঘরটি মেরামত করে রেকর্ডরুম করলেন যার নাম দিলেন “তথ্যালয়(রেকর্ডরুম)”।
টাকা নাই তাই অফিস প্রাঙ্গনে অবস্থিত কিছু গাছের ডাল কেটে শেলফ বানিয়ে শুরু করলেন রেকর্ড তথা নথি গোছানোর কাজ। ইনভেন্টরি সহকারে মৌজাওয়ারি, সনওয়ারি, রকমওয়ারি নথিগুলোকে এত সুন্দর করে সাজিয়েছে যে, কোন তথ্য বের করতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগে না। সবচেয়ে বড় কথা অত্র এলাকার মানুষের সম্পত্তির সম্পত্তি তথা গুরুত্বপূর্ণ নথিসমূহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেল। প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার সাধারণ মানুষকে সহজভাবে ও দ্রুত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে স্থাপন করা হয় হেল্পডেস্ক যার নাম দেয়া হয় “সেবালয়(ফ্রন্টডেস্ক)”।
সেবালয়ে বসার জন্য তিনটি বেঞ্চ, দেয়ালে সাঁটানো ফেস্টুন (সাধারণ মানুষের ভূমি বিষয়ক জ্ঞান দেয়ার জন্য) ও একটি টেবিলে বসে ক্রমিক নম্বরসহ স্লিপ দিচ্ছেন একজন অফিস সহায়ক, যে স্লিপে কোন সেবা কোন কক্ষে কোন ডেস্কে পাবে তা উল্লেখসহ পরবর্তী কোন তারিখে সাক্ষাৎ হবে তার বিবরণ দেয়া হয়। এই সেবালয়ের বিনিময়ে সাধারণ মানুষ বেঁচে গেলো মধ্যস্বত্ব শ্রেণী তথা দালালদের হাত থেকে।
এসি ল্যান্ড এর নিজের কক্ষের নাম “আপনালয়”, সর্বসাধারণের আপন যে জন তার কক্ষের নাম আপনালয় এর সার্থকতা এখানেই। তিনি স্লিপধারী প্রত্যেকটি মানুষকে সিরিয়াল অনুযায়ী ডাকছেন, মনোযোগ দিয়ে শুনছেন, সমস্যার দিচ্ছেন সমাধান অথবা লিখে রাখছেন নিজের ডায়রিতে। নিজের ডেস্কে ছিল না কোন কম্পিউটার বা অন্য কোন ইলেক্টনিক্স সামগ্রী। স্টোর রুমে ফেলে রাখা নষ্ট মনিটর, কম্পিউটার সিস্টেম, প্রিন্টার জড়ো করে একটা সেট দাঁড় করিয়েছেন।
রামগতি উপজেলা ভূমি অফিসের আমূল পরিবর্তনের বিষয়ে ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ রবিউল হাসান বলেন, কিছু টাকা পেলে মেরামত করাবেন এবং আক্ষেপ করে বললেন, একটা লেমিনেটিং মেশিন ও স্পাইরাল বাইন্ডিং মেশিন সেই স্টোর রুম থেকে উদ্ধার করে সচল করেছেন যা নষ্ট হয়ে যেত হয়ত আর কিছুদিন পর।
অফিসের প্রত্যেকটি কক্ষের সামনে সহকারী, সার্ভেয়ার, কানুনগো সহ সকল স্টাফদের নামফলক দিয়ে ডেস্ক চিহ্নিত করে পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে গলায়। অফিসের বারান্দা সংলগ্ন জায়গা পরিস্কার করে স্থাপন করে করা হয়েছে মনোরম ফুল বাগান যার নাম দেয়া হয়েছে “ক্ষণিকালয়”।
বাগানে লাগানো হয়েছে টগর, কামিনী, বেলী, রঙ্গন, বাগানবিলাস প্রভৃতি প্রজাতির ফুলের গাছ। ঝুলিয়েছেন একটি কবিতা
“এই মাটিকে ভালবেসে দেখো
পাবে প্রাণ, পাবে মুগ্ধতা
এই ভূমিকে ভালবেসে দেখো
পাবে সেবা, শ্বেত সভ্যতা”
মূল অফিসটার পিছনটা আগাছা আর জংলী গাছে ভরা ছিল। তিনি তা পরিস্কার করে নিজ হাতে গড়েছেন ফলের বাগান যার নাম দেন “রসালয়”। বাগানটা দু’ভাগে বিভক্ত, একপাশে হাড়িভাঙ্গা, আশ্বিনী, আম্রপালী, ল্যাংড়া, মহানন্দা, ফজলী, গোপালভোগ, রাজশাহীভোগ, সীডলেস প্রভৃতি প্রজাতি নিয়ে গড়া আম বাগান, অন্যপাশে আমলকি, আমড়া, জলপাই, হরিতকি প্রভৃতি প্রজাতির ফলদ ও ঔষধি গাছ, বাগানের দুই অংশ প্রভেদকারী হিসেবে আছে চায়না টু ও চায়না ত্রি জাতের লিচু গাছ।
উপজেলা ভূমি অফিসের পরিবর্তনের নায়ক সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ রবিউল হাসান আরো জানান, উপজেলা ভূমি অফিসের নিজস্ব ওয়েবসাইট বানানোর কাজ চলমান যা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করাসহ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্র তৈরি করা হবে।
আগে শোনা যেত এ পদে যারা এসেছেন তারা বেশিদিন ছিলেন না ফলে কোনকিছু করা সম্ভব হয়নি অথচ বর্তমান এসি ল্যান্ড যোগদান করেছেন মাত্র দু’মাস অথচ যা করেছেন তা অনেকে দু’বছরেও করা সম্ভব হয়নি। জমির খাজনা কত, নামজারির ফি কত, ভূমি সংক্রান্ত নানা তথ্য সম্বলিত ফেস্টুন অফিসের বাইরে জনসাধারণের চলার পথে টাঙিয়ে দিয়ে সচেতন করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সত্যিকারের আন্তরিকতা, ন্যায় নীতি ও ডেডিকেশন থাকলে কিনা করা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রামগতি উপজেলার বর্তমান এসি ল্যান্ড জনাব মোঃ রবিউল হাসান।
0Share