জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ের সহকারী কাজী মুহাম্মদ আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। তিনি অর্পিত সম্পত্তি, সরকারি জমি, বেনামে ভূমিহীন চারটি প্লট দখল করেছেন। কারসাজি করে কয়েকটি জমি বিক্রি করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী এসব জমি বিক্রি করা যায় না। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে স্থানীয় ২৪ ব্যক্তি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে আবদুর রহিম তাঁর এক আত্মীয়ের নামে উপজেলা ভূমি অফিসসংলগ্ন পালপট্টিতে ১০ শতাংশ জমি লিজ নেন। সম্প্রতি (এক বছর আগে) স্থানীয় প্রহলাল মজুমদার, এজুস পাল, শিপুল পাল ও দিলীপ ঘোষের কাছে প্রায় ৬০ লাখ টাকায় ওই জমি বিক্রি করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আবদুর রহিম তাঁর বাবা কাজী আবদুল মান্নান (নথি ৫৯৯/৮৮/৮৯), চাচা আবদুর রশিদ (৫৯৬/৮৮/৮৯), স্ত্রী রেজিয়া বেগম (৫৯৮/৮৮/৮৯), বোন কোহিনুর বেগম ও ভগ্নিপতি মফিজুল ইসলামের নামে (৫৯৮/৮৮/৮৯) ভূমিহীন সম্পত্তি ভোগ করছেন। বিভিন্ন মৌজার এসব জমির কিছু অংশ সম্প্রতি তিনি বিক্রি শুরু করেছেন।
ভূমি অফিস সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ৫ মে লক্ষ্মীপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. মোফাজ্জল হোসেন এক চিঠিতে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দেন। তিনি নতুন তালিকা প্রণয়নের জন্য রায়পুর সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) এ নির্দেশ দেন। তখন আবদুর রহিম ওই অফিসের নিম্নমান সহকারী এবং অর্পিত সম্পত্তির তালিকা তৈরির দায়িত্বে ছিলেন। এ সময় তিনি উপজেলাব্যাপী অর্পিত সম্পত্তির বেশ কিছু নথি ও তালিকা গায়েব করেন। এতে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা এবং ‘ক’ ও ‘খ’ গেজেটে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে গায়েব করা ওই অর্পিত সম্পত্তি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামে ভিন্ন জরিপে রেকর্ড করে দেন।
রায়পুর বাজারের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি খরিদ সূত্রে একটি দোকান ভিটার মালিক। দোকানটির সংস্কারকাজ শুরু করা হলে ভূমি অফিস থেকে লোক এসে বন্ধ করে দেয়। পরে রহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানান, এটি ভিপি সম্পত্তি। আমি জমির জমাখারিজের কাগজপত্র দেখালে বলেন, এটি বালামে নেই। পরে রহিমকে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে দোকান করেছি।’
অভিযোগ রয়েছে, আবদুর রহিম অর্পিত সম্পত্তির প্রত্যেক নথিতে একরে ১০ হাজার টাকা এবং চান্দিনা ভিটিতে (একসনা বন্দোবস্তে দেওয়া হাটবাজারের জমি) ৪০-৫০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, পূর্ব চরপাতা গ্রামের আবদুর রহিম ১৯৮৮ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেন। তখন থেকে উপজেলার অর্পিত, খাস, একসনা বন্দোবস্ত, নামজারি ও জমাখারিজের বেশির ভাগ নথি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এতে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বর্তমানে পৌরসভার ধানহাটায় একটি বহুতল ভবন (নির্মাণাধীন), পূর্ব চরপাতা গ্রামে মা মঞ্জিল ও এমদাদ মিয়াজী সড়কে দুটি সেমি পাকা দোকানঘর করেছেন। এ ছাড়া উপজেলার পূর্ব চরপাতা, উত্তর চরপাতা, দেনায়েতপুর, চরমোহনা ও চরবংশীসহ আরো কয়েকটি স্থানে অন্তত ২০ একর জমির মালিকানা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাসজমি ও অর্পিত সম্পত্তি রয়েছে। তাঁর স্ত্রী রেজিয়া বেগম ও পরিবারের সদস্যদের নামে এসব জমি নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী গ্রামে বাবুরহাটসংলগ্ন এক একর ৪৪ শতাংশ অর্পিত সম্পত্তি রয়েছে আবদুর রহিমের নামে। সাত বছর ধরে জমিটির স্থানীয় তত্ত্বাবধায়ক উত্তর চরলক্ষ্মী গ্রামের রহিম। তিনি বলেন, ‘আমি এ জমিতে সয়াবিন ও ধান আবাদ করি। মৌসুমের সময় মালিক এসে তাঁর ভাগ তিনি নিয়ে যান।’
এ ছাড়া চরমোহনা গ্রামে (চরবংশী স্টিল ব্রিজ সংলগ্ন) প্রায় দেড় একর খাসজমির মালিক আবদুর রহিম। ডাকাতিয়া নদীর পূর্বপাড়ে এ জমি। সেখানে সেগুন ও কড়ইসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাঝারি ও মোটা আকৃতির শতাধিক কাঠগাছ দেখা গেছে। স্থানীয় তত্ত্বাবধায়ক পূর্ব চরবংশী গ্রামের আবদুল মান্নান মাঝি বলেন, ‘বহু আগে ভূমি অফিসে থাকাকালে রহিম সাহেব প্রায় দেড় একর জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন। মাঝেমধ্যে তিনি এসে এসব দেখে যান।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইউপি সদস্য বলেন, ‘অফিস সহকারী আবদুর রহিম কিভাবে এত ধনসম্পদের মালিক তা বোধগম্য নয়। তবে তিনি যে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটিপতি বনে গেছেন, তা সবার জানা। ভূমি অফিসে থাকাকালে অর্থনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে সব কাজই তিনি করেছেন। তাঁর দাপটের কাছে লোকজন অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়ে।’
রায়পুরের পূর্ব চরপাতা গ্রামের ইয়াকুব হোসেন, শরিফ হোসেন ও শাহাদাত হোসেন জানান, রহিমের অবৈধ সম্পদের ছবি ও তথ্যসহ তাঁরা বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা প্রশাসনের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘রহিম চাকরি জীবনের ২৮ বছরের বেশির ভাগ সময় রায়পুরে কাটিয়েছেন। ভূমি অফিসই তাঁর পছন্দের জায়গা। বিভিন্ন সময় সদর, রামগতি, কমলনগর ও রামগঞ্জে ছিলেন। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে, তখন তিনি ওই দলের সিনিয়র নেতাদের কাছের লোকজন বনে যান।’
অভিযুক্ত রায়পুর ইউএনও কার্যালয়ের সহকারী কাজী আবদুর রহিম বলেন, ‘একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে একই অভিযোগ বারবার প্রশাসনিক বিভিন্ন দপ্তরে দিয়ে আমাকে হয়রানি করছে। উপস্থাপিত অভিযোগগুলো আগেও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।’ কত একর জমির মালিক? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারি খাস, অর্পিত সম্পত্তি এবং স্ত্রীসহ পারিবারিক মিলে ৮-৯ একর হবে। এসব আমার নিজের একার না, পারিবারিক।’
সংবাদ সূত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ
0Share