মোহাম্মদ শাহ আলম: রায়পুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনের কিছু ইতিহাস আমরা অনেকেই জানি না। । রায়পুরে তখন মাধ্যমিক পর্যায়ের পর উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশুনার জন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। রায়পুর জনপদের সামর্থবান ছাত্র-ছাত্রীগন কলেজ পর্যায়ে অধ্যয়নের জন্য দূরবর্তী ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের কলেজে ভর্তি হতো। অনেকে লক্ষ্মীপুর,চৌমুহনী কলেজে রায়পুর থেকে যাওয়া-আসা করে পড়াশুনা করতেন।অনেকে কলেজের অভাবে উচ্চশিক্ষা হতে বঞ্চিত হয়। রায়পুরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন থেকেই রায়পুরের মুসলিম জমিদার মিয়াবাড়ির জমিদার মরহুম এস্কান্দার আলী চৌধুরীসহ রায়পুরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে এলেন।
মরহুম এস্কান্দার আলী চৌধুরী সে সময় বাংলাদেশের বৃহত্তম ইউনিয়ন ৬ নম্বর কেরোয়া ইউনিয়ন পরিষদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় চেয়ারম্যান। তাঁকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলেন খাকসার আন্দোলনের নেতা রায়পুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম মাওলানা ছাইফুল আলম ইত্তেহাদি,৫ নম্বর রায়পুর ইউনিয়ন এর তৎকালীন চেয়ারম্যান মরহুম মৌলভী মজিবুল হক, রায়পুরের কৃতি সন্তান মরহুম অধ্যাপক সিরাজ আহমেদ (পরবর্তীতে কলেজের শিক্ষক), মক্তিযুদ্ধে রাজাকারদের হাতে নিহত মরহুম হাবিবুল্লা ছৈয়াল, রাখালিয়া চৌধুরী বাড়ির মরহুম তসলিম উদ্দিন চৌধুরী, তখনকার যুব নেতা মরহুম নুরুল ইসলাম আযুব, মরহুম আজিজুল হক মুন্সী, মরহুম নুরুল ইসলাম মুন্সী, মরহুম সালামত উল্লাহ ওভারসিয়ার, রায়পুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম মনসুর আহমেদ, এল এম স্কুলের প্রধান শিক্ষক মরহুম আলী আজগর, রায়পুর মার্চ্চেন্টস একাডেমি’র প্রধান শিক্ষক মরহুম সুলতান আহমদ, রায়পুর গার্লস স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মরহুম বশির উল্লাহ মাস্টার, রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মরহুম কামালুদ্দিন খান হুজুর,এল এম প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মরহুম শফি উল্লাহ,মরহুম এমদাদ উল্লাহ মিয়াজী, মরহুম আব্দুর রশিদ গান্ধী, মরহুম ফজলুলকরিম চৌধুরী, কেরোয়া মুন্সী বাড়ির পিয়ারু মিয়া, কাজী বাড়ির মরহুম কাজী ওহিদুর রহমান (পরে ৬ নং কেরোয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ), ৭ নং বামনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পন্ডিত বাড়ির মরহুম আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া, হায়দারগঞ্জের মরহুম আব্দুল বারিক হাওলাদার প্রমুখ।
১৯৭০ সালে এল এম স্কুল মাঠে একটি জনসভার আয়োজন করে মরহুম এস্কান্দার আলী চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ৩১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। একই বছর রায়পুর এল এম পাইলট মডেল হাই স্কুলের নিচতলার তিনটি কক্ষে কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। রায়পুর কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফরিদগঞ্জ উপজেলার চরমুগুয়া গ্রামের মরহুম প্রিন্সিপাল ছালেহ আহমদ। শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেন মরহুম আনোয়ার উল্লাহ (পরবর্তীতে অধ্যক্ষ ), অধ্যাপক মরহুম সিরাজ আহমেদ, অধ্যাপক রসূল আহমেদ,অধ্যাপক আবুল হাসেম, খণ্ডকালীন শিক্ষক স্বর্গীয় বাবু কেশব চন্দ্র ভৌমিক। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে এল এম স্কুলে পাক বাহিনী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে স্কুলের আসবাবপত্র, কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয়। তখন রায়পুর কলেজের কার্যক্রম ও বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে পুনরায় নতুন উদ্যমে রায়পুর কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় কলেজ পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন মরহুম মাওলানা ছাইফুল আলম ইত্তেহাদি, মরহুম মাস্টার বশির উল্লাহ, জনাব ফজলুল করিম ছৈয়াল, মরহুম মৌলভী মজিবুল হক চেয়ারম্যান , মরহুম নুরুল ইসলাম আযুব প্রমুখ।
স্বাধীনতা’র পর বর্তমান স্থানে রায়পুর কলেজের নিজস্ব স্থাপনা নির্মাণের জন্য উল্লেখিত ব্যক্তিগণ (বিশেষ করে মাওলানা ছাইফুল আলম ইত্তেহাদি এবং মরহুম নুরুল ইসলাম আযুব) বেশ কিছু সাহসী ভূমিকা নিলেও তা বিতর্কের সৃষ্টি করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত রিলিফের টিন কলেজের কাজে ব্যবহার করা হয় এবং রায়পুর বাজারের কয়েকটি পরিত্যক্ত ঘর মালিকের অনুমতি ছাড়াই জোরপূর্বক ভেঙে তা কলেজের শ্রেণীকক্ষ নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া কলেজের জন্য বর্তমান জায়গা দান করার ক্ষেত্রে মিয়াবাড়ির ওয়ারিশগণ একমত হতে পারেন নাই।মরহুম গজনফর আলী চৌধুরী’র জ্যাঠাত ভাই আলী আহমদ চৌধুরী, এবং মোতাহার উদ্দিন চৌধুরী ভূমির দখলদার না থাকলেও প্রায় ছয় একর জায়গা কলেজের নামে রেজিস্ট্রি করে দেন যাতে মরহুম গজনফর আলী চৌধুরীর নি:সন্তান বিধবা পত্নী মাকসুদা আখতার খানম এর সম্মতি ছিল না। এ নিয়ে দীর্ঘদিন মামলা চলে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত মামলার রায় কলেজের পক্ষেই যায়। তখন রায়পুর বাজার হতে কলেজের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাজারে বিক্রয় করা পাট, ধান, মরিচ, সুপারি ইত্যাদি মালামালের উপর মন প্রতি ২ টাকা করে চাঁদা ধার্য্য করা হয়। সে সময় কুরবানী পশু কেনা-বেচার স্থান ছিল রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ। হাসিলের পরিবর্তে গরু প্রতি দশ টাকা এবং ছাগল প্রতি পাঁচ টাকা কলেজের জন্য আদায় করা হয়। এতে রায়পুরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল। অধ্যক্ষ জনাব ছালেহ আহমেদ অন্য কলেজে চাকুরী নেয়ার কারণে পরবর্তী সময়ে অধ্যক্ষ জনাব আনোয়ার উল্লাহ কলেজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বর্তমান রায়পুর সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য রায়পুরের যেসব শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন তাঁদের নাম এখন বিস্মৃত।
বস্তুত এ লিখাটিও রায়পুর সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের খণ্ডিত অংশ মাত্র। এ লিখাটিতেও অনেকের নাম উল্লেখ করা সম্ভব হয় নি। কলেজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মহৎ হৃদয়ের মানুষের কোনো কার্যক্রমই ব্যক্তি স্বার্থে ছিল না বিধায় তাঁদের কোনো কাজে বিরূপ ধারণা পোষণ করার অবকাশ নেই। যাঁদের ত্যাগে,পরিশ্রমে, অর্থে, দান- অনুদানে রায়পুর সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আল্লাহ্পাক তাঁদের কোনো ভুল-ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করে বেহেস্ত নসিব করুন ।
লেখক: অতিরিক্ত সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।
0Share