সানা উল্লাহ সানু: লালন তাঁর দশ হাজার অনুসারি শিষ্যকে কী উপদেশ দিতেন তা জানবার একমাত্র উপায় তাঁর গান। লালনের গানের ভাষা সহজ হলেও তার মর্ম সহজ নয়। লালন গানে গানেই তাঁর জীবন সংসার গড়ে ছিলেন। লালনের গানগুলো দেশের লোকসংগীত কে সম্মৃদ্ধ করেছে। ঠিক লালনের মতোই উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরে শুধু গান গেয়েই জীবন পরিচালনার স্বপ্ন দেখেছেন যে কয়জন গান প্রিয়সী তাদের মধ্যে হোসেন বয়াতি অন্যতম। লালনের সারা জীবনের ধ্যান ছিল একতারা নিয়ে। কিন্তু হোসেন বয়াতি ধ্যান তার একমাত্র দোতারা নিয়ে। কন্ঠ ও সুরের যাদু দিয়ে গ্রামীণ মানুষের কাছে খ্যাতিমান তিনি। গান গেয়ে লোক সমাগম ধরে রাখার মন্ত্র হোসেন বয়াতির অসাধারণ। তার সবচেয়ে বড়গুণ স্থানীয় যে কোন ঘটনাকে তাৎক্ষনিক ছন্দবদ্ধ রসাত্মক সুরে অঞ্চলিক গানে রুপ দিতে পারেন এ শিল্পী।
কিন্তু গান পাগল হোসেন বয়াতির জীবনের শেষ সময় যাচ্ছে এখন অতি দুঃখ কষ্টে। এক সময় গ্রামের হাটবাজারে তাকে সব সময় দেখা গেলেও এখন সে রকম দেখা যায় না। কারণ গান গেয়ে এখন আর তার সংসার চলে না। তাই এখন বাধ্য হয়েই সরকারি বিভিন্ন প্রচারনা মূলক গানে সময় দেন। সে জন্য লক্ষ্মীপুর জেলা তথ্য অফিসের হয়েই এখন গান করেন তিনি। সে আয় দিয়েই কোন রকম চলে তার সংসার। এমনটাই জানিয়েছেন হোসেন বয়াতি।
শতশত লোকগানে তিনি সুরাপরোপ করেছেন এবং গেয়েছেন। লিখেছেন প্রায় শতাধিক লোকগান।বহু বছর আগে নিজের লেখা এবং স্থানীয় গীতিকার অহিদ উদ্দিন রতনের লেখা কয়েকটি গান নিয়ে নিজে সুরারোপ করে বের করেছেন লোকগানের এ্যালবাম ‘কলিকালের গান’ । এছাড়া ‘মজিদ মালতির কবিতা’ নামে আরো একটি এ্যালবাম বেশ সাড়া জাগিয়েছে।
তিনি জানান,
বছর ২ আগে স্টোকে আক্রান্ত হয়ে স্মৃতি শক্তিও অনেকটা হারিয়ে ফেলেছেন এ শিল্পী। ফলে তার স্মৃতি থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে নিজের লেখা অসাধারন কথার শতাধিক গান। কিন্তু তার সহায়তায় এগিয়ে আসেনি কেউ। এখন আক্ষেপ জীবিত থাকতেই যদি নিজের গানের পান্ডলিপি ও ক্যাসেট রের্কড করে যেতে পারতেন।
হোসেন বয়াতির জন্ম লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম লক্ষ্মীপুর গ্রামে। যেটি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ৩ নং ওর্য়াডভুক্ত। বাবা শাহাদাত আলী গাজী। বাবার দুঃখের সংসার এবং গানের প্রতি ভালোবাসার কারণে মাত্র ১০ বছর বয়সেই গ্রামের ওস্তাদ মোঃ জালাল মিয়ার শিষ্যত্ব গ্রহন করেন হোসেন। এরপর দীর্ঘ ৪০ বছর কেটে যাচ্ছে গান গেয়ে। তিনি জানান, লোকসংগীত কে ভালোবাসেন নিজের জীবনের মতোই। একটি মাত্র দোতারাই হোসেন বয়াতির একমাত্র সম্বল। তাই সব সময় অতি যত্নে পুষে রাখেন তার সে দোতারাটি।
গান ভালোবেসে এক সময় হোসেন বয়াতির সাথে দল বেধেঁছেন হুমায়ুন বয়াতি, আমিন(গায়ক) বয়াতি, জহর আলী(বাদক কাসার জুড়ি), স্বপন বয়াতি, সুব্রত পোদ্দার (বাদক ঢোল)।
নিজের গানের দল আর দোতারা নিয়ে তিনি ওস্তাদের দেখানো পথ ধরে হেটেঁ বেড়িয়েছেন, ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালীসহ উপকূলীয় বহু জেলায়। এ সকল জেলার ছোট বড় বিভিন্ন শহর, হাট-বাজার, গ্রাম ও নদীর ঘাটে তাঁর ভাবশিষ্যদের নিয়ে গান গেয়েছেন এবং ঘুরে বেড়িয়েছেন পথ প্রান্তরে। বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠান এবং হাটবাজারের কবিরাজি ঔষধ বিক্রিকালে জারিগান, পল্লিগান, মারফতি, মুরশিদি, কবিগান শ্রেতাদের আকৃষ্ট করেছেন।
“যেজন প্রেমের ভাব জানে না, যার সাথে নাই লেনা দেনা,,,,, নকল সোনার” মত অসংখ্য লোকগান গেয়ে ও দোতারা সুর তুলে যাচ্ছেন তিনি। মূলত লোকগান ও আধ্যাত্মিক ধারার গানের জন্য লক্ষ্মীপুর জেলা ব্যাপী শহর কিংবা গ্রামে পরিচিত তিনি। গান কে অবলম্বন করেই তার জীবিকা। শুধু গান গেয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি রচনা করেছেন ২ শতাধিক গান। কিন্তু পান্ডুলিপি তৈরি করতে পারেন নি। সবগুলোই মুখস্ত। এখন তার প্রত্যাশা নিজের গানের পান্ডলিপি এবং নিজের সুরে আরো কয়েকটি এ্যালবাম। আর তাদের মতো বাউল ধারার শিল্পীদের বাচিঁয়ে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা।
প্রসঙ্গত:লোকসংগীত সংগীত রাজ্যের একটি অন্যতম ধারা। লোকসংগীতের মাধ্যমে গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনের কথা, সুখ-দুঃখের কথা ফুটে ওঠে। লোকসংগীতের জন্য খুব বেশি যন্ত্রের ব্যবহার করা হয় না। মূলত কথা আর সুরই গানগুলির প্রধান আকর্ষণ। লোকসংগীতের মধ্যে বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, কবিগান অন্যতম। অধিকাংশ লোকসংগীতের সাথে একটা করে মিষ্টি গল্প জড়িয়ে থাকে।
0Share