জুনাইদ আল হাবিব: “নিজে গান লিখেন, সে গান গান গেয়ে শুনান বন্ধুদের। কখনো দেশাত্মবোধক, কখনো আধুনিক গান। কবিতা, গল্প, লেখাতেও তার বেশ হাতেখড়ি। এক নাগাড়ে স্পষ্ট উচ্চারনে ইংরেজীতে কথা বলাতেও রয়েছে তার অসাধারণ দক্ষতা। ক্রিকেটসহ অন্যান্য গ্রামীণ ঐতিহ্যের খেলায়ও দক্ষ খেলোয়াড় সে। অথচ সে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি। শুনেই কেমন গাবড়ে গেলেন ” গল্পটা, ১৯বছরের তরুণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মো. নাজিম উদ্দিনের। বাড়ি লক্ষ্মীপুর উপশহর দালাল বাজার এলাকায়। দরিদ্র পরিবারে। বাবা মোহাম্মদ কবির হোসেন পেশায় রাজমিস্ত্রি ও মা নাজমুন নাহার গৃহিনী। তিন ভাই বোনের পরিবারে নাজিম সবার বড়। কষ্ট দায়ক হচ্ছে নাজিমের অন্য ভাই বোনও অন্ধ। একই পরিবারে তিন ভাই বোন অন্ধ। যে সময় নাজিমের মতো অসংখ্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধী অদক্ষ জীবনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তখন নাজিম সফলতার সাথে পড়ছে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে।
এবার সে এইচএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও পড়ালেখায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্য দশজনের মতো সক্রিয়। সে স্কীন রিডার ব্যবহার করে ফেসবুক চালায়। নাজিম উপকূলীয় শিক্ষার্থীদের সংগঠন আলোকযাত্রা লক্ষীপুর দলের সদস্য। দেয়াল পত্রিকা বেলাভূমিতে সে লিখছে নিয়মিত। এত কিছুর পরও নাজিমদের প্রতি মানুষের বৈরি মনোভাব এখনো বদলাইনি। অনেকে মনে করে ওরা সমাজের বোঝা। বহু প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে ওদের এগুতে হয়। দালাল বাজার সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম হোস্টেল। সেখান থেকেই বেড়ে ওঠেছে নাজিম। এন.কে উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি সম্পন্ন হয়। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য চান্স পেয়েছে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে।
কিন্তু, বহু সংকটকে সাথে নিয়ে নাজিমদের পথচলা। “স্কুল পরীক্ষাগুলো ব্রেইল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতো সে। অন্যদিকে কেন্দ্রের পরীক্ষাগুলো দিতে হয়েছে অন্যভাবে। সে যে শ্রেণিতে পড়বে, সে শ্রেণির নিচের শ্রেণির পড়ুয়াকে সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। কারণ, তারাতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। হাতে কলমতো তারা লিখতে পারেনা। আর তাদের জন্য কলেজে ব্রেইল পদ্ধতির কোন সুবিধা নেই। যা নাজিমকেও পদে পদে ভোগান্তিতে ফেলে। তাদের পরীক্ষা যারা দেয় তাদেরকে প্রতিটি বাক্য বানান করে বলতে বলতে সময় শেষ হয়ে যায়। কলেজে ব্রেইল পদ্ধতি ও ব্রেইল বই নেই। স্কুল লেভেলে বিনামূল্যে বই থাকলেও কলেজে তা নেই। তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? জানতে চাইলে নাজিম বলেন, “সমাজের অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের প্রতি বৈরি হলেও কিছু ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম। আসলে ভালোবাসা আর ঘৃনা এ দু’টি মিলেই পৃথিবীর বন্ধন।
তবে আমি অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষ করে আমার সহপাঠীরা আমাকে সঙ্গ দিয়ে সুখ- দুঃখের কথাগুলো শেয়ার করে। আর আমি হয়তো কোন কোন সময় পড়তে আসতে হলে বন্ধুদের ও মানুষের সহযোগিতায় নিই। আর তা যখন সম্ভব হবেনা, যখন একা একাই গাড়ির চালকদের মাধ্যমে কলেজে আসি ও বাড়ী ফিরি।” গান ও লেখালেখি সম্পর্কে জানতে চাইলে নাজিম আরো বলছিলেন, “আমি দেশাত্মবোধক-আধুনিক গান রচনা ও গল্প, কবিতা, উপন্যাস লিখেছি। যেগুলো এখনো অপ্রকাশিত! কোন গণমাধ্যমে সুযোগ পেলে আমি সেখানে আমার লেখা গুলো প্রকাশ করবো।” কথা হয় নাজিম উদ্দিনের মায়ের সাথে। দৃষ্টিহীন ছেলের এগিয়ে চলা পেছনের গল্প জানতে হয় মা কামরুন নাহারের কাছে।
তিনি বলছিলেন, স্কুলে ভর্তি করে তাকে যে দিন স্কুলে দিতাম, সে দিন তার জন্য বেশ চিন্তা করতাম। ওই দিন আমার আর সংসারের কোন কাজ হতোনা। হয়তো ক্লাস শেষ হওয়া পর্যন্ত তার জন্য অপেক্ষা করতাম। তা না হলে, বাড়ি থেকে গিয়ে তাকে এগিয়ে নিয়ে আসা লাগতো। কিন্তু তাতে আমার কোন দুঃখবোধ নেই। ছেলেকে আজকের এই অবস্থানে আনতে পেরে আমিও খুশি। আমি চাই আমার ছেলে জীবনে অনেক বড় কিছু হোক। ছেলেকে নিয়ে এটাই আমার স্বপ্ন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধি নাজিম বাস্তবতায় বিশ্বাসী। তাঁর ইচ্ছা এইচএসসি শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তাঁর স্বপ্ন বিচারপতি হওয়ার। নাজিম মনে করে, প্রকৃতিতে কিংবা সমাজ ব্যবস্থায় বিচারের মানদন্ড এমন হওয়া উচিত, যেখানে মানুষের মধ্যে কোন বৈষম্য থাকবে না।
0Share