আজিজুর রহমান আযম: শিক্ষকতা একটা মহান পেশা। দুনিয়াতে আর এমন একটি পেশা নেই যা সম্মানের দিক থেকে শিক্ষকতা পেশার সমান। শিক্ষকরা সোনার মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম। এখানে শিক্ষকগণ তাদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার জন্য পুলিশের লাঠি পেটা খেতে হয়। অনেকে পুলিশের নির্যাতনে নিহত হয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ময়মনসিংহ এর ফুলবাড়িয়া ডিগ্রী কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদকে জাতীয়করনের আন্দোলন করার কারণে পুলিশের লাঠি পেটায় নিহত হতে হয় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সারা দেশের জনগণ জানতে পারে। এটা শিক্ষক সমাজের জন্য রাষ্ট্রের এক চরম ট্রাজেডি।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার ও জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। শিক্ষার গুনগত উন্নয়ন ব্যতিরেকে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার অধিকার পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হলে জনসাধারণের অন্যান্য অধিকার আদায়ের পথ সুগম হবে। অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও আমাদের সংবিধানে শিক্ষা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত পায়নি। কারণ শিক্ষাখাতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বরাদ্দ হল জিডিপির ৬ শতাংশ এবং বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে এ বরাদ্দ জিডিপির ২.২ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫ শতাংশের আশেপাশেই উঠানামা করছে। বিভিন্ন দেশের জিডিপিতে শিক্ষাখাতের অনুপাত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৬১টি দেশের মধ্যে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের দিক থেকে বাংলাদেশ ১৫৫তম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান যুদ্ধতাড়িত আফগানিস্তান ও ইরাক থেকেও অনেক কম। আইনগত অধিকার না থাকায় বেসরকারী শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য বার্ষিক ৫% ইনক্রিমেন্ট, পূর্ণাঙ্গ বাড়ী ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মত পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা, শিক্ষা ভাতা, পাহাড়িয়া অ লে চাকুরীরত শিক্ষকদের জন্য পাহাড়ি ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বি ত হয়ে আসছে। এটি একেবারেই অনভিপ্রেত।
বেসরকারী শিক্ষকদের অধিকার নিশ্চত করতে সরকারী উদ্যোগ এবং পর্যাপ্ত সমর্থন না থাকায় তারা সর্বদাই বি ত হয়। উদাহরণ স্বরূপ দেখা যায় বেসরকারী শিক্ষকদের বাড়ীভাড়া পান ১০০০ টাকা। বাড়ী ভাড়াতো দূরের কথা বাড়ীর বারান্দাও ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা। তা নিন্তাতই অপ্রতুল এবং উৎসব ভাতা পান স্ব-স্ব স্কেলের ২৫ ভাগ। পুরো চাকুরী জীবনে মাত্র একটি ইনক্রিমেন্ট পেয়ে থাকেন। যা বর্তমানেও বন্ধ রয়েছে। বেসরকারী কলেজের শিক্ষকদের পদোন্নতির কোন সুবিধা ব্যবস্থা নেই। যা আজকের বিভিন্ন দৈনিকে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। যেমন বেসরকারী কলেজে এমন অনেক মেধাবী শিক্ষক/শিক্ষিকা আছেন যাদের এস.এস.সি থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যন্ত অনেক বিষয়ে প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত এবং তাদের অনেকেই আবার এমফিল ও পিএইচ.ডি ডিগ্রীর অধিকারী হয়েও পদোন্নতিতে অনুপাত থাকার কারণে সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন না। তাদের এত উচ্চ মানের ডিগ্রী থাকার পরও ট্রেজেডিটা হলো তাঁদের অনেক হতভাগ্য শিক্ষক-শিক্ষাকে পুরো চাকুরী জীবনে প্রভাষক হিসাবে জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। বেসরকারী কলেজে পদোন্নতির কোন সুব্যবস্থা না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখন এই সম্মাণিত পেশায় আসতে চরম অনিহা প্রকাশ করেন। পৃথিবীর কোন উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে এমন তুঘলকী প্রথা আছে বলে আমাদের জানা নেই।
এরই ফলশ্রতিতে “শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রাম কমিটি” জাতীয়করণসহ ১১ দফা দাবিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীবৃন্দ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। আগামী ১৪ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষক-কর্মচারীদের মহাসমাবেশে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। গত শনিবার থেকে সারা দেশে সংগ্রাম কমিটির ডাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট চলছে। একই দাবিতে আজ ও মঙ্গলবার সব জেলায় শিক্ষক-কর্মচারীরা সবাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করবেন। এ সময়ের মধ্যে সরকারের তরফ থেকে কোনো ইতিবাচক ঘোষণা না আসলে ১৪ মার্চ মহাসমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রাম কমিটির সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ আসাদুল হক বলে, আমরা মহাসমাবেশ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যে কোনো মূল্যে এ কর্মসূচী পালিত হবে। জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষক মহাসমাবেশ (১৪ মার্চ) সফল করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় অব্যাহত রেখেছি। গত শুক্রবার আমরা একাধিক বৈঠক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে জাতীয়করণসহ ১১ দফা দাবিতে গত ২৭ জানুয়ারি থেকে টানা তিনদিনের ক্লাস বর্জন কর্মসূচির পাশাপাশি শিক্ষক নেতারা দাবি আদায়ের পক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দেরসহ গণমাধ্যমের কর্মী, মানবাধিকার কর্মীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন। অধ্যক্ষ আসাদুল হক বলেন, আশা করেছিলাম বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার ১১ দফা দাবির যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেবে। ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণে পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ কারণে আবারও সারা দেশের শিক্ষক-কর্মচারীরা এক হয়ে মহাসমাবেশ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারীর ১১ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের মত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের ৫ শতাংশ বার্ষিক বেতন প্রবৃদ্ধি, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বাংলা নববর্ষ ভাতা, বাড়ি-ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা প্রদান করা, অনুপাত প্রথা বিলুপ্ত করে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রদান ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুরূপকরণ ও শিক্ষক-কর্মচারীদের পূর্বের ন্যায় টাইম স্কেল প্রদান, শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রদান করা, ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষাখাতে জিডিপি’র ৬ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখাসহ বিভিন্ন দাবি করা হয়েছে।
আশা করি বর্তমান শিক্ষা-বান্ধব সরকার ভিশন-২০২১ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক কে বিজয়ী করতে হলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি সমূহ ঘোষণা অবিলম্বে প্রদান করতে হবে। না হলে দেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে এবং শিক্ষকরা তাদের যৌক্তি দাবি সমূহ পূরণের জন্য আমরণ অনশন, ক্লাস বর্জনসহ অন্যান্য একাডেমিক কার্যবলী থেকে বিরত থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে দাবি আদায়ের জন্য অনির্দিষ্ট কালের জন্য মাঠে নেমে পড়বে। তাতে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের যে ধারাবাহিকতা তা দারুন ভাবে ব্যহত হবে এবং সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
লেখক :
সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, দালাল বাজার ডিগ্রি কলেজ, সদর,লক্ষ্মীপুর।
0Share