কাজল কায়েস: সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনে এরই মধ্যে সম্ভাব্য কয়েকজন প্রার্থীর দৌড়ঝাঁপ, গণসংযোগ, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, খাদ্যসামগ্রী বিতরণ ও অনুদান দেওয়ার ঘটনা লক্ষ করা যাচ্ছে। নির্বাচনী এলাকার বর্তমান সংসদ সদস্য তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব লায়ন এম এ আউয়ালকে সম্প্রতি পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় নির্বাচনে নতুন হিসাব-নিকাশ তৈরি হয়েছে। জোটগত কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর অব্যাহতিতে বর্তমানে ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। দলটির সম্ভাব্য প্রার্থী আছেন অন্তত ছয়জন।
অন্যদিকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের অস্বস্তি জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) নিয়ে। এ আসনে এলডিপির যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম মনোনয়ন পাওয়ার জন্য জোর লবিং করছেন। তিনি রাজনীতি ও সমসাময়িক বিষয়ে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে টক শোতে অংশগ্রহণ করে এরই মধ্যে জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছেন। তবে এলডিপিকে এখানে ছাড় দিতে নারাজ স্থানীয় বিএনপি।
শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘বিএনপি এ আসনে আমাকে মনোনয়ন দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এরই মধ্যে হাইকমান্ড থেকে আমাকে সংকেত দিয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আমি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। আমি নির্বাচন করলে বিজয় নিশ্চিত হবে।’
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে রশিদ মিয়া আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
এরপর আর এ আসনে জয় পায়নি আওয়ামী লীগ। এরশাদের স্বৈরশাসনের পতনের পর ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপি থেকে নির্বাচিত হন জিয়াউল হক জিয়া। প্রয়াত এই সংসদ সদস্য প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। নবম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেন বিএনপির নাজিম উদ্দিন আহমেদ। বিএনপি ছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব এম এ আউয়াল সংসদ সদস্য হন।
গত ১৮ এপ্রিল তরিকত ফেডারেশনের দপ্তর সম্পাদক মো. সেলিম মিয়াজী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এম এ আউয়ালকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতির কথা জানানো হয়। তাঁর পরিবর্তে সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীকে দলের মহাসচিব হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
তবে আগামী নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য আউয়াল বলেন, ‘রামগঞ্জে গত সাড়ে চার বছরে এক হাজার কোটি টাকার রাস্তাঘাট, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন উন্নয়নকাজ করেছি। তরিকত ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে সমৃদ্ধ রামগঞ্জ গড়ার চেষ্টা করেছি। আমার করা উন্নয়ন আর জোটগত কারণে যদি আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়, তাহলে অসমাপ্ত কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে পারব।’
আওয়ামী লীগ : দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ কয়েক ভাগে বিভক্ত। পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। পরীক্ষিত-ত্যাগী কিছু নেতাকে উপেক্ষা করে প্রবাসী ও দলে যোগ দেওয়া কয়েকজনকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে টাকার বিনিময়ে তাঁদের পদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৭১ সদস্যের কমিটির প্রায় বেশির ভাগ নেতাই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেন। এতে দলের সাংগঠনিক ও আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠনে নেতৃত্বের সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন। বর্তমান সংসদ সদস্য আউয়ালকে তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিবের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। যাঁরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আলোচনায় আছেন তাঁরা হলেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সফিকুল ইসলাম, দলের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক এম এ মমিন পাটওয়ারী, জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোজাম্মেল হক মিলন, রামগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি সফিক মাহমুদ পিন্টু ও সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন খান। তাঁদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন খান ইউনিয়নগুলোতে এবং পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় বিনা মূল্যে খাদ্য, বস্ত্র ও অর্থ সহায়তা এবং স্কুল, মাদরাসা, কলেজসহ ধর্মীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিচ্ছেন। মো. শাহজাহান রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এবং একাধিকবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ২০১৪ সালেও আওয়ামী লীগ তাঁকে মনোনয়ন দেয়। পরে জোটগত কারণে দলের সিদ্ধান্তে তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন। দলের সাংগঠনিক ভিত পাকাপোক্ত করতে সরকারি বরাদ্দ দিয়ে রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন তিনি। এ ছাড়া শাহজাহান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদান করে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সফিকুল ইসলামও নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালে করা উন্নয়নের কথা জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁকে সমর্থন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। মমিন পাটওয়ারীও নিয়মিত উঠান বৈঠক ও নারী সমাবেশ করছেন। তিনি সরকারের উন্নয়ন সাফল্য জনগণের কাছে তুলে ধরে শেখ হাসিনার জন্য নৌকায় ভোট চাইছেন।
আনোয়ার হোসেন খান বলেন, ‘অসহায় মানুষের পাশে থেকে আমি রামগঞ্জের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছি। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে এবং নৌকার বিজয়ের লক্ষ্যে আমি কাজ করে যাচ্ছি।’
মো. শাহজাহান বলেন, ‘আমি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অক্লান্তভাবে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছি। সরকারের বিভিন্ন সাফল্য জনগণের কাছে তুলে ধরছি। আমাকে মনোনয়ন দিলে আমি রামগঞ্জ আসনটি উপহার দিতে পারব।’
সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি শেখ হাসিনার গত ৩১ বছরের একজন ত্যাগী এবং পরীক্ষিত কর্মী। রামগঞ্জে আমার ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। ১৯৯৬ সালে দল থেকে মনোনয়ন পেয়ে ভোট করেছি। সেখানে পরিকল্পিতভাবে ভোট ডাকাতি করে আমাকে বিএনপি হারিয়েছে। ১৯৮৬ সালে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যে উন্নয়ন করেছি, তা এখনো মানুষের মুখে মুখে।’
মমিন পাটওয়ারী বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলাম। শেখ হাসিনার নির্দেশে রাজনৈতিক সংগ্রাম-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছি। এ কারণে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় প্রায় ৯ মাস আমাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে। এখনো দলের জন্য কাজ করছি। দল আমার ত্যাগ ও কাজের মূল্যায়ন করবে।’
সৈয়দ মোজাম্মেল হক মিলন বলেন, ‘দুঃসময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করেছি। হামলা-মামলার পরও কখনো পিছু হটিনি। সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীদের সাথি হিসেবে ছিলাম। আমাকে মনোনয়ন দিলে বিজয়ী হব।’
সফিক মাহমুদ পিন্টু বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে কাজ করছেন। আমিও তাঁর একজন কর্মী হিসেবে সে লক্ষ্যে কাজ করছি। রামগঞ্জে উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে আমি মনোনয়ন চাইব। তবে দল যাঁকেই মনোনয়ন দেবে, আমি তাঁর হয়ে কাজ করব।’
বিএনপি : রামগঞ্জ উপজেলা বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। দলটি ক্ষমতায় থাকাকালে দৃশ্যমান কিছু উন্নয়ন করেছে। তবে বর্তমানে দলটির কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। এর ঢেউ লেগেছে তৃণমূলে।
দলীয় নেতাকর্মীরা জানায়, বিএনপি নেতারা হয়রানি এড়াতে ঘরোয়া সংক্ষিপ্ত আলোচনাসভার মধ্য দিয়ে তাঁদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখছেন। নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি না সে প্রশ্নে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছেন বলে জানান দলটির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী।
আগামী নির্বাচনে বিএনপি থেকে সাবেক সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমেদ, জেলা বিএনপির সহসভাপতি মনির আহমেদ ও দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
নাজিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে আমরা অংশ নিতে প্রস্তুত আছি। এখানকার ৮০ শতাংশ লোক আমাদের দল করে। বর্তমান সরকারের অত্যাচার-অবিচারে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। আমি আবার মনোনয়ন পেলে ধানের শীষ জয়ী হবে।’
হারুনুর রশিদ বলেন, ‘দল আমাকে মনোনয়ন দেবে। আমার সঙ্গে সব স্তরের নেতাকর্মী ও জনগণ আছে। আমি তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের বিপদাপদে ছিলাম। তারা আমাকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী করবে।’
মনির আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে দেশ ও জনগণের কল্যাণ হয়। দলীয় নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত রাখতে অতীতেও কাজ করেছি, ভবিষ্যতেও করব। যথাযথ মূল্যায়ন করে দল আমাকে মনোনয়ন দেবে—এমনটাই প্রত্যাশা করছি।’
অন্যান্য : আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও তরিকত ফেডারেশন ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক তৎপরতা নেই বললেই চলে। তবে রামগঞ্জ উপজেলা শাখা জাতীয় পার্টির সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম পাটওয়ারী, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মো. মনির হোসেন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) এম এ গোফরান নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
0Share