কাজল কায়েস: লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর ও সদরের একাংশ) আসনটি ‘খালেদার ঘর’ হিসেবেই পরিচিত। কারণ এ আসন থেকে খালেদা জিয়া দুইবার নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু সেই ‘খালেদার ঘরেই’ বিএনপি এখন ছত্রভঙ্গ। দলের সাধারণ নেতাকর্মী ও ভোট থাকলেও জ্যেষ্ঠ নেতাদের গাছাড়া মনোভাব আর একঘেয়ে সিদ্ধান্তের কারণে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবার স্থানীয়ভাবে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দিতে নারাজ। জোটগত কারণে দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছিল। তখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ নোমান। তিনি পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উপদেষ্টাও। এবারও জাতীয় পার্টিকে নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ভয় আছে।
আরো পড়ুন: রামগঞ্জ আসনে ফুরফুরে আ. লীগ অস্বস্তিতে বিএনপি
যদি মহাজোট বা গতবারের মতো কোনো ধরনের সমঝোতা হয় তাহলে আসনটি আবার জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের। অন্যদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের শক্তিশালী দাবি করলেও ভোটের হিসাবে এখনো দলটি পিছিয়ে রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
উল্লেখ্য, নব্বইয়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপি নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহ। এরপর ৯৬ সালের জুন ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ৯৬ সালে খালেদা জিয়া আসনটি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু তখন বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হারুনুর রশিদ। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া আসনে বিজয়ী হন জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়া। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তখন আওয়ামী লীগের টিকিট পান ডা. এহসানুল কবির জগলুল। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক।
পরে অবশ্য জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। দলীয় সিদ্ধান্তে এহসানুল কবির জগলুল মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় পার্টি নেতা মোহাম্মদ নোমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোহাম্মদ নোমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনার ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। আমার সততা দিয়ে দলমত- নির্বিশেষে জনগণের সমঅধিকার নিশ্চিত করে আমি জনসমর্থন তৈরি করেছি। নিজে যেমন চাঁদাবাজি করিনি, তেমনি কোনো চাঁদাবাজও সৃষ্টি করিনি। জনগণ আমার সঙ্গে আছে, তারাই আমাকে বিজয়ী করবে।’
আওয়ামী লীগ : এ আসনে আওয়ামী লীগের রাজনীতি মূলত রায়পুর থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয়। বর্তমানে এখানে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট। রায়পুর উপজেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মামুনুর রশিদ, সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খোকন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বাবুল পাঠান ও পৌর কমিটির আহ্বায়ক জামশেদ কবির বাক্কি বিল্লাহর ব্যক্তিগত অফিসকেন্দ্রিক রাজনীতি চলছে। নেতাকর্মীরা একজনের ব্যক্তিগত অফিসে গেলে অন্যজন আড় চোখে তাকান। নেতাকর্মীরা জানায়, আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ এসব নেতার মুখে ঐক্যের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তাঁদের মধ্যে অনেকটা দা-কুমড়া সম্পর্ক। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সরকারি কাজের জন্য ডাকা দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও কাজ ভাগ-বাটোয়ারায় তাঁরা এক। পছন্দের নেতার অনুসারী হয়ে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতারা নিজেদের মতো করে ‘ভাই জিন্দাবাদ’ বলে ‘হাসিখুশির রাজনীতি’ করছেন।
এদিকে ২০০৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের ৬৮ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ও ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর পৌর আওয়ামী লীগের ২৭ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময় সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হলেও রহস্যজনক কারণে সম্মেলন হয়নি। সর্বশেষ গত ৩০ জুন পৌর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের দিন ঠিক করেন দলের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নূরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন। ১২ মে অনুষ্ঠিত পৌর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তিনি এই দিন ঠিক করেন। তবে পরে জেলা কমিটির সভাপতি গোলাম ফারুক টিংকু চিঠি দিয়ে সম্মেলন না করার জন্য বলেন।
দলের এমন সাংগঠনিক অবস্থার মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হয়ে যেতে পারে। নেতাকর্মীরা বলছে, যদি তা-ই হয় তাহলে এর প্রভাব নির্বাচনেও পড়তে পারে। জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান দলের কেন্দ্রীয় যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশিদ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সহসভাপতি এহসানুল কবির জগলুল, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ আলী খোকন ও সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শামছুল ইসলাম পাটওয়ারী। তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া এবং ভোটারদের আস্থা অর্জন করার উদ্দেশ্য এহসানুল কবির জগলুল ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্প ও ওষুধ বিতরণ কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এরই মধ্যে রায়পুরের পাঁচটি ইউনিয়নে তিনি এই সেবা দিয়েছেন। এহসানুল কবির জগলুল বলেন, ‘ছাত্রলীগের মাধ্যমে আমার রাজনীতি শুরু। এরপর পেশাজীবী সংগঠন এবং সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছি। এলাকার দেড় শতাধিক ছেলে-মেয়েকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছি। দল আমাকে মনোনয়ন দেবে বলে বিশ্বাস রাখছি। আমি নির্বাচিত হলে সারা দেশের মধ্যে এ আসনকে মডেল এবং আদর্শ এলাকা হিসেবে গড়ে তুলব। বেকার যুবকদের সরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে চাকরি নিশ্চিত করার পাশাপাশি এলাকায় শিল্প-কারখানা করব।’ নূরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন বলেন, লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী লীগ এখন সুসংগঠিত। আগামী নির্বাচনে জেলার চারটি আসনেই দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে পরিকল্পনা অনুযায়ী সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। তিনি বলেন, ‘লক্ষ্মীপুর-২ আসনে দলীয় নেতাকর্মী ও জনগণের অনুরোধে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে আমি নিজেও কাজ করছি।’ মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে হামলা-মামলা করে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হয়রানি করেছে। তখন আওয়ামী লীগের একজন নেতাও তাদের পাশে দাঁড়াননি। তাঁরা এলাকায়ও ছিলেন না। আমি নেতাকর্মীদের সাহায্য-সহযোগিতা করে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করেছি। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে আসনটি উপহার দিতে পারব।’
সাবেক সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের এই ৯ বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে, স্বাধীনতার পর এত বেশি উন্নয়ন আর হয়নি। নেত্রী যাঁকেই মনোনয়ন দেন, আমরা তাঁর হয়ে কাজ করব। আমি এমপি থাকাকালে যে অবদান রেখেছি এবং দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছি সে কারণে দল আমাকে মনোনয়ন দেবে বলে মনে করছি।’
শামছুল ইসলাম পাটওয়ারী বলেন, ‘এলাকায় উন্নয়ন ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য আমি মনোনয়ন চাইব। দল ও জনগণের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি। ছাত্রজীবন থেকে শেখ হাসিনার নির্দেশে সব আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে আছি।’
এ ছাড়া বাশমী ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুল বাকিন ভূঁইয়া ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান আলাদা সংবাদ সম্মেলন করে প্রার্থী হওয়ার কথা জানিয়েছেন। এর পর থেকে তাঁরা নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন স্থানে ব্যানার, পোস্টার লাগিয়ে সরকারের সাফল্য প্রচার করছেন।
বিএনপি : জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মাঠে তৎপরতা থাকলেও হামলা-মামলা ও পুলিশের হয়রানির ভয়ে বিএনপির প্রকাশ্য প্রচারণা নেই। যদিও এ আসনে দলের প্রতি নীরব জনসমর্থন রয়েছে বলে দাবি করছে বিএনপি। তবে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে মান-অভিমান এবং বিভক্তি রয়েছে। এতে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম। দল ক্ষমতায় থাকার সময় সুফল ভোগ করা নেতাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা। একসময়ের জনপ্রিয় নেতাদের রাজনীতিতে কোণঠাসা করে রাখার কারণে তৃণমূলে ক্ষোভ রয়েছে। এ অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির টিকিট চান জেলা কমিটির সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়া ও খালেদা জিয়ার প্রধান নিরাপত্তা সমন্বয়কারী কর্নেল (অব.) আবদুল মজিদ। সাবেক সংসদ সদস্য আবুল খায়ের ভূঁইয়া বলেন, ‘জেলা ও উপজেলার সব স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও পুলিশ আমাদের নেতাকর্মীদের হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। তারা আমাদের ঘরোয়া অনুষ্ঠানও করতে বাধা দিচ্ছে। শান্তিপূর্ণ নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জেলার চারটি আসনেই বিএনপিকে বিজয়ী করবে জনগণ।’
0Share