মিসু সাহা নিক্কন, রামগতি: লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার দুর্গম ও ভূখন্ড থেকে বিছিন্ন চর আবদুল্লার মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক অধিকার থেকে পিছিয়ে রয়েছেন। তাঁদের পিছিয়ে রেখে দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। চরের মাটি উর্বর, মানুষও পরিশ্রমী। তাঁরা পরিশ্রমের মাধ্যমে বালুময় চরকে সবুজে রূপান্তর করেছেন। কৃষি ও প্রাণিসম্পদে তাঁদের অবদান এখন স্বীকৃত। কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক অধিকারে তাঁরা পিছিয়ে রয়েছেন। তাই চরের মানুষের এসব অধিকার নিশ্চিত করে তাঁদের কাছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা পৌঁছে দিতে হবে। সেবা না পেয়ে দিনকে দিন চরের মানুষের মাঝে অনাগ্রহ সৃষ্ঠি হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে চরের সংকট, সম্ভাবনা ও সক্ষমতাকে দেখতে হবে।
চরগুলোতে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিক যা ছিল তা বর্তমানে বন্ধ । সেখানে নতুন করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে সেগুলোর ভবনকে বন্যার সময় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। চরগুলোর সঙ্গে মূল ভূখণ্ডে যাতায়াতের জন্য কয়েকটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালু করলে শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা সহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ সুবিধা পাবে।
সরেজমিনে দক্ষিণ চর আবদুল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রাক প্রাথমিক শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৬৮জন, ১ম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৯৬জন, ২য় শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ১০৩ জন, ৩য় শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৬০ জন, ৪র্থ শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৬৫ জন এবং ৫ম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী রয়েছে মাত্র ১২জন। এরমধ্যে বালক ১৮৪ এবং বালিকা ২৩১ জন। উপস্থিতি ৬০% থাকলেও নানা কারণে ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।
শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে চরের শিশুদের জন্য কাজ করার সময় এখনি। কারণ, শিশুরা সব সময় তাঁদের অধিকার ও সুবিধাপ্রাপ্তির দাবি রাখে। বেড়িবাঁধ, নদীভাঙন ও জোয়ারের লবনাক্ত পানি লোকালয়ে প্রবেশে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি সাধন হওয়া চরের একটি বড় সমস্যা। এ কারণে চরের মানুষের দারিদ্র্য মূল ভূখণ্ডের মানুষের চেয়ে বেশি। চরে যৌতুক ও বাল্যবিবাহ বেশি। সেখানে স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার ও এনজিওগুলোকে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে কাজ করতে হবে।
কাউকে পেছনে রেখে উন্নয়ন সম্ভব না—এটিই সরকারের টেকসই উন্নয়ন কৌশল। তাই প্রচলিত সরকারি সুবিধাগুলো চরের মানুষ পান কি না, তা তদারকি করা জরুরি।
চরগুলো গবাদিপশু লালন-পালনের উর্বর ক্ষেত্র ফলে এ চরে প্রাণিসম্পদ বিভাগের সেবা বাড়াতে হবে। চরের মানুষ যাতে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাবিষয়ক পরামর্শ পান, সে জন্য সেখানে ডিজিটাল সেবার মান বাড়াতে হবে। চরের মানুষের মধ্যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, চরগুলো মূল ভূখণ্ড থেকে বেশ দূরে। তাই তাঁদের মৌলিক অধিকার ও চাহিদার সুযোগ করে দিতে হবে। এগুলো নিশ্চিত করা গেলে তাঁরাই তাঁদের মতো জীবন সাজিয়ে নিতে পারবেন।
চরের কৃষিজমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তায় বড় ধরনের প্রভাব রাখা সম্ভব হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে চরের কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সরকারের পাশাপাশি সব অংশীজনের সমন্বিত উদ্যোগে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে চরের মানুষের জীবনমানের টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব। চরগুলোয় আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। আমাদের দেশের অনেক ক্ষেত্রে একটি প্রধান সমস্যা চিকিৎসকদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকতে না চাওয়া। ফলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার পাশাপাশি চিকিৎসকরা যাতে কর্মস্থলে থাকেন, সেই পরিস্থিতিও তৈরি করতে অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে চরবান্ধব শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
বাংলাদেশ আজ টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের উদাহরণ হলেও চরাঞ্চলের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় লক্ষণীয়। তাছাড়া ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বা সরকার পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলো এখানে নেই। সারা দেশ এগিয়ে গেলেও বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের বিচারে এ অঞ্চলগুলো এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। এখানে যেমন পর্যাপ্ত উর্বর ভূমি রয়েছে, তেমনি রয়েছে মানবসম্পদ। তাছাড়া পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্র হতে পারে এ অঞ্চল। এভাবে নতুন কর্মসংস্থানের উৎস হতে পারে চর। তাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে চরের বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান নিশ্চিতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণের বিষয়গুলোও বিবেচনা জরুরি।
মিসু সাহা নিক্কন/10/22
0Share