মোঃ মাহবুবুল ইসলাম ভূঁঞা: লক্ষ্মীপুরে যৌতুক না পেয়ে বিয়ের তিন মাসের মাথায় সালমা আক্তার জান্নাত নামের এক গৃহবধুকে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে স্বামী ও শাশুড়ীর বিরুদ্ধে। অন্যদিকে অভিযোগ ওঠেছে নৃশংস এ হত্যাকান্ডকে ধামাচাপা দিতে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও প্রভাবশালীদের চাপের মুখে ১ লক্ষ টাকায় সমঝোতা হওয়ায় হত্যাকান্ডের পর ১০ পেরিয়ে গেলেও থানায় কোন মামলাই হয়নি ।
নিহতের স্বজন, এলাকাবাসী ও পুলিশ জানায়, তিন মাস পূর্বে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চরলামছি গ্রামের মৃত ছানা উল্যার ছোট মেয়ে সালমা আক্তার জান্নাতের সাথে বিয়ে হয় একই উপজেলার পশ্চিম লক্ষ্মীপুর গ্রামের শাহাদুল্যার ছেলে খলিলের।
নিহতের স্বজনরা জানান, বিয়ের সময় মেয়ের জামাইকে বিদেশ পাঠানোর জন্য টাকা যৌতুক দেয়ার কথা থাকলেও সালমার দরিদ্র বিধবা মা তা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় প্রতিনিয়ত শারিরিক ও মানসিক অত্যাচার চলে সালমার উপর। তারই জের ধরে গত ১১ জুলাই সন্ধ্যার পর এ নিয়ে সালমা ও তার স্বামী খলিলের সাথে বাক-বিতন্ডা হয়।
এর প্রায় ঘন্টাখানেক পরেই খলিলদের ঘরের পার্শ্ববর্তী একটি নির্জন ঘরের সামনে অগ্নিদগ্ধ হয় সালমা। সালমার আর্তচিৎকারে আশেপাশের লোকজন ছুটে এসে আগুন নিভিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করেন। কিন্তু আগেই সালমার শরীরের প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ অংশ পুড়ে যায়।
ঘটনার পর পরই সালমার স্বামী খলিল পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে সালমার শারিরীক অবস্থার অবনতি হলে ওই রাতেই তাকে সদর হাসপাতাল থেকে ঢাকা নেয়ার পথে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ এলাকায় সে মারা যায় । খবর পেয়ে পুলিশ রাতেই সালমার মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।
পরদিন (১২ জুলাই) সন্ধ্যার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে মৃতদেহ নিহতের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে ওই রাতেই নিহতের বাবার পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এদিকে সালমা হত্যাকান্ডের পর পরই তার পরিবারের পক্ষ থেকে এ নৃশংস পৈশাচিক হত্যাকান্ডের বিচার দাবী করা হলেও এ হত্যাকান্ডকে ধামাচাপা দিতে সক্রিয় হয়ে উঠে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
অভিযোগ রয়েছে মামলা না করার জন্য তৎপর হয়ে উঠে স্থানীয় চররুহিতা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আবুল বাসার ও দালালবাজার ইউনিয়নের ইউপি সদস্য বাচ্চু মেম্বার। তারা দু’জনেই স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি ও একজন আইনজীবি সহকারীর সহযোগিতায় এ হত্যাকান্ডকে ধামাচাপা দিতে সালমার দরিদ্র বিধবা মা ও তার পরিবারের সদস্যদের উপর চাপ সৃষ্টি করে।
তারা দু’জনেই স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি ও একজন আইনজীবি সহকারীর সহযোগিতায় এ হত্যাকান্ডকে ধামাচাপা দিতে সালমার দরিদ্র বিধবা মা ও তার পরিবারের সদস্যদের উপর চাপ সৃষ্টি করে। হত্যাকান্ডের পরদিন সালমার মা পারুল বেগম ও তার স্বজনরা সাংবাদিকদের কাছে সালমা হত্যার বিচার চেয়ে বক্তব্য দিলেও শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালীদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে লক্ষ্মীপুর জজ কোর্ট বিল্ডিং এর নিচতলায় এ হত্যাকান্ডকে ধামাচাপা দিতে ১ লক্ষ টাকায় সমঝোতা করে দেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
নিহত সালমার ভগ্নিপতি রেদোয়ান হোসেন বলেন, সালামার স্বামী একজন নেশাগ্রস্থ। সে বিদেশ যাওয়ার টাকা এনে দেয়ার জন্য চাপ দিত এবং প্রায়ই আমার শ্যালিকাকে মারধর করত। ঘটনার দিন এ নিয়ে সালমার সাথে বাক-বিতন্ডার একপর্যায়ে তার স্বামী, শাশুড়ী ও তাদের সাথে কয়েক জন আমার শ্যালিকাকে মারধর করে মুখে কাপড় বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করে।
নিহত সালমার মা পারুল বেগম বলেন, আমরা গরিব মানুষ। এলাকার মেম্বার চেয়ারম্যানদের কাছে আমরা যেতে হয় সব সময়। তাদের কথা না রাখলে পরে সমস্যা হবে। তারা মামলা করতে নিষেধ করেছেন।
কিন্তু চররুহিতা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আবুল বাসার বলেন, উভয় পক্ষই গরিব। মেয়েটি আগুনে পুড়ে কি ভাবে নিহত হয়েছেন তা আমরা জানিনা। উভয় পক্ষ যেন হয়রানী না হয় তাই সমঝোতা করে দিয়েছি।
লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ আনোয়ার হোসেন জানান, সালমার মাথার পিছনের কিছু চুল ও পায়ের পাতা ছাড়া শরীরের প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ পুড়ে গেছে। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে কিছু ক্ষত চিহ্ন থাকলেও এগুলো আঘাতের কারণে হয়েছে নাকি আগুন লাগার কারণে হয়েছে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবুও এটি হত্যা না আত্মহত্যা তা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ ক্রমে পরে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে।
এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর আইনজীবি সমিতির সভাপতি জি এম আবদুর নুর জানান, এসিড মারা বা কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা এ ধরণের অপরাধ মীমাংসাযোগ্য নয়। কেউ মীমাংসার উদ্যোগ নিয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ফৌজদারী আইনে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে।
এদিকে সালমা হত্যাকান্ডের ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও মামলা না হওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ গিয়াস উদ্দিন মিয়া জানান, বিয়ের তিন মাসের মাথায় নব এ গৃহবধু সালমার অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক। সালমার পরিবারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কেউ কোন অভিযোগ দাখিল করেননি। আমরা থানায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পঠিয়েছি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রতিবেদক:লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি সময় টেলিভিশন
0Share