কাজল কায়েস: লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে এলাকায় যান না। তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে লক্ষ্মীপুর শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে সপরিবারে বাস করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যে এলাকায় চেয়ারম্যানরা প্রাণের ভয়ে বাস করতে পারেন না, সেখানে সাধারণ মানুষ বাস করে কিভাবে? সদর উপজেলার হাজিরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ওমর ফারুক বলেন, ‘২০১১ সালের ডিসেম্বরে সন্ত্রাসীরা আমার ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এর পর থেকে আমি তাদের ভয়ে লক্ষ্মীপুর শহরের পুলিশ ফাঁড়ির সামনের একটি বাসায় ভাড়া থাকছি। ওই হত্যা মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) থেকে আসামিদের নাম কর্তন করা হয়েছে। আমাদের নারাজির পরিপ্রেক্ষিতে এখন সিআইডি (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) তদন্ত করছে।’ চরশাহী ইউপি চেয়ারম্যান গোলজার মোহাম্মদ বলেন, ‘দিদার বাহিনী, সোলেমান বাহিনী ও কফিল বাহিনীর সন্ত্রাসীদের কাছে কেউই নিরাপদ নয়, এমনকি জনপ্রতিনিধিও নন। তাদের কারণে চরশাহী ও আশপাশের এলাকায় ডাকাতিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। নানাদিক বিবেচনা করে পারিবারিক সিদ্ধান্তের কারণে আমি দেড় বছর ধরে লক্ষ্মীপুর শহরের বাগবাড়িতে বাসা নিয়ে বাস করছি।’ চন্দ্রগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বাচ্চু বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের হাতে বিপুল পরিমাণ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। তারা যখন-তখন প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া নিয়ে নামে। এ জন্য আমি আতঙ্কে এলাকায় না থেকে লক্ষ্মীপুর শহরে বাসা ভাড়া করে থাকি।’ তিনি ভয়ে তাঁর বাসার ঠিকানাও বলেননি। অন্য একটি সূত্র জানায়, তিনি প্রায় দেড় বছর ধরে শহরে বাস করছেন। একটি সূত্র জানায়, আধিপত্য, প্রকাশ্য অস্ত্রের মহড়া, চাঁদাবাজি, অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি, ডাকাতি, হত্যা, মাদক ব্যবসা, গোলাগুলি ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় ওই চেয়ারম্যানরা আতঙ্কিত। তবে চেয়ারম্যানরা বলছেন, জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। জেলা ইউনিয়ন পরিষদ ফোরামের নেতারা বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর নৈরাজ্যের কথা উপস্থাপন করেছেন। বৈঠকে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাতেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। তিন ইউনিয়নের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চন্দ্রগঞ্জে বহিষ্কৃৃত বিএনপি নেতা সোলেমান উদ্দিন জিসান বাহিনী, হাজিরপাড়ায় ছাত্রলীগ নেতা নিজাম উদ্দিন মুন্না বাহিনী ও চরশাহীতে যুবদল নেতা দিদার হোসেন ও সোলেমান বাহিনী দুই-তিন বছর ধরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। গত ১৫ মে মান্দারী ইউনিয়নের জমিরতলী এলাকায় দত্তপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন শামীম ও তাঁর দুই সহযোগীকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আসাদুজ্জামান বাবুল বাহিনীর লোকজনের সঙ্গে শামীম বাহিনীর কয়েক ঘণ্টা বন্দুকযুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। সে সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও শীর্ষসন্ত্রাসী লাদেন মাসুমসহ ৯ জনকে আটক করে। অন্যদিকে ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাত ১টায় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন হাজিরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ওমর ফারুকের ভাই ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মনির হোসেন। তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে জেলা ছাত্রলীগ সহসভাপতি নিজাম উদ্দিন মুন্না ও তাঁর বাহিনীর সদস্যরা। এ বিষয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান পাটওয়ারী দাবি করেন, ‘মুন্না কোনো সন্ত্রাসী নয়। সে মেধাবী ছাত্রনেতা। হাজিরপাড়া ইউপির চেয়ারম্যান ওমর ফারুকের ভাই মনির আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে নির্মম নির্যাতন ও এমনকি হত্যায় জড়িত। মনির হত্যা মামলায় রাজনৈতিক কারণে মুন্নাকে প্রধ
ান আসামি করা হয়েছে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চরশাহী ইউপির এক সদস্য জানান, সম্প্রতি ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সোলেমানের সমর্থক জসিম উদ্দিনকে আধিপত্য নিয়ে ডান পায়ে কয়েক রাউন্ড গুলি করে দিদার বাহিনীর সমর্থকরা। গত ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে চরশাহী ইউপি কার্যালয় থেকে জসিম হোসেনকে পাইপগান ও এক রাউন্ড গুলিসহ স্থানীয় লোকজন আটক করে থানা পুলিশে সোপর্দ করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাজিরপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান, একেকটি সন্ত্রাসী বাহিনীতে ৩০-১৫০ জন সদস্য রয়েছে। এসব বাহিনীর প্রায় সদস্যদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা রয়েছে। সন্ত্রাসীদের ভয়ে সব সময় তাদের আতঙ্কে থাকতে হয়। সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্কের মাত্রা বাড়তে থাকে। এলাকার ব্যবসায়ী, প্রবাস ফেরত ব্যক্তি ও অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছলদের কাছে ওই বাহিনীর সদস্যরা মোবাইল ফোনে ও সরাসরি চাঁদা দাবি করে। সন্ত্রাসীদের চাহিদামতো চাঁদা দিতে ব্যর্থ হলে বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, পিটিয়ে জখম ও পায়ে গুলি করা হয়। অন্য জেলায় গিয়ে আহতরা গোপনে চিকিৎসা নেন। তাদের ভয়ে কেউ থানা পুলিশ ও সাংবাদিকদের কাছে ঘটনা জানাতে চায় না। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অভিযুক্ত চরশাহীর দিদার হোসেন ও সোলেমান একে অপরকে দোষারোপ করেন। তবে দুজনেরই দাবি, তাঁরা জনগণের জন্য রাজনীতি করেন। কিছু লোক তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। লক্ষ্মীপুর জেলা ইউনিয়ন পরিষদ ফোরাম ও ৪ নম্বর চররুহিতা ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির পাটওয়ারী বলেন, ‘নিরাপত্তার অভাবে তিন চেয়ারম্যান লক্ষ্মীপুর শহরে বাসা ভাড়া করে থাকেন।’লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম আলাউদ্দিন বলেন, ‘সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলে কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে।’ লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপি সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়া বলেন, ‘পুলিশ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করছে না।’লক্ষ্মীপুর সদর থানার ওসি মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে সত্য। তিন চেয়ারম্যান এলাকায় ভয়ে যান না, এটি কেউ আমাকে জানায়নি।’জেলা প্রশাসক এ কে এম মিজানুর রহমান বলেন, ‘চেয়ারম্যানরা সুনির্দিষ্টভাবে জানালে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলা হবে।’
0Share