জুনাইদ আল হাবিব: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের শিশুরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ-খাইয়ে নিতে না পারায় অনেক শিশু জীবনের শুরুতেই মারা যান। অযত্ন-অবহেলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মৃত্যু ঝুঁকির মাঝে বেড়ে ওঠছে শিশুরা। এসব শিশুদের নিয়ে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে অনেক ভয়ঙ্কর তথ্য। মাঠ পর্যারের তথ্য সংগ্রহ করে এ নিয়ে দশ পর্বের ধারাবাহিক বিশেষ প্রতিবেদন লিখেছেন লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোরের শিক্ষানবীশ কন্ট্রিবিউটর জুনাইদ আল হাবিব। আজ পড়ুন এর দ্বিতীয় পর্ব…
দিন-রাত উত্তাল নদীর বুকে ছুটে চলা। ঘুম নেই, নেই খাওয়া- দাওয়া। ভাবনায় কেবল, কীভাবে ইলিশ শিকার করা যায়? সে চিন্তা। কীভাবে পরিবারের অন্ন যোগানো যায়। কখনো প্রাণ ঝরে দুর্যোগের কবলে, কখনো ঢেউয়ের অভিশাপে, কখনো জলদস্যুদের আক্রমণে! হ্যাঁ, আমি জেলে শিশুদের গল্পই বলছি। ওরাতো এখনো শিশু। ওদেরতো এখন থাকার কথা স্কুলে। ওরা বড় হবে, দেশ চালাবে। কিন্তু ওরা এখন নৌকার দক্ষ মাঝি হওয়ার স্বপ্ন দেখে! তাদের ওপরেই ভরসা পরিবারের। লাভের আশায় ওদের মা-বাবা ওদের সাগর-নদীতে পাঠায়। অনেকের বাবা জেলে। নিশ্চয় তিনি তার ছেলেকে মাছ ধরতেই পাঠাবেন। পরিশ্রম করার এখনো মনো-মানসিকতা এখনো যাদের গড়ে ওঠেনি। তারাই এখন শিশু শ্রমে দিন পার করছে। তাদের বেড়ে ওঠা গতিরোধ হচ্ছে। সে ছেলেরা আরেকটু বয়স হলে নুইয়ে পড়বে। কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলবে। ওটা কে ভাবে? জেলের অভিভাবকররা ভাবে,না, সমাজ ব্যবস্থা?
মো. রাসেদ। বয়স ১৪পার হয়েছে। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চর মার্টিন। বাবা সাগরে ইলিশ ধরে। সে যখন ৩য় শ্রেণি থেকে ৪র্থ শেণিতে উর্ত্তীর্ণ হয়েছে, তখনই তার বেড়া ওঠা গতিরোধ হয়। তার ঠিকানা এখন আর স্কুল নয়, তাকে যেতে হয় নৌকায়! রাসেদ ক্রিকেট খেলায় একজন মারকুটে ব্যাটসম্যান ও বোলিং হিসেবেও বন্ধুদের মাঝে ছিল বেশ পরিচিত। সে জানায়, “আমি পড়ালেখায় ফিরে যেতে চাই। কিন্তু মা-বাবা আমাকে সংসারে অভাব দেখিয়ে নদীতে পাঠিয়েছে। এখন নিয়মিত আঁরে মাছ ধরতে যাইতে হয়। তারা যেভাবে বলে আমাকে সেভাবে চলতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই।”
কতটা ঝুঁকি এই পেশায়? এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলছিলো, “ঝুঁকির কোন শেষ নেই। বিভিন্ন সময়ের ঝড়-তুফানের ভিতরেও আঁরে নদীতে যেতে হয়। না গেলে, আমি যে মাঝির অধীনে মাছ ধরতে যাই সেতো আমাকে আর কাজে লাগাবেনা। সিগন্যালের টাইমে এমন এমন অবস্থার মধ্যে পড়ি যে, নৌকা ডুবে যাওয়ার ভয় থাকে।”
ওর মতো একই গ্রামের আকবর (১৫), রহমান (১২), মনিরের(১৬)। ওদের জীবনের গল্পটাও এমন। স্কুলের খাতায় ওদের নাম ছিলো, কিন্তু ওদের ভাগ্যে শিক্ষার আলো স্পর্শ তেমন ঘটেনি।
আর এসব গল্পই বলে দেয়, প্রান্তিকের বিপন্ন কিংবা বিচ্ছিন্ন জনপদে কেন পড়ালেখা থেকে ছিটকে পড়ছে শিশুরা? মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে শিক্ষার প্রসারে যত উদ্যোগ নেওয়াএগুলো এখন অকার্যকর রূপ পরিগ্রহ করছে।
যার ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বহু দুরন্ত শিশুর ভবিষ্যত স্বপ্ন। জেলে ও আড়তদারের সংগঠন লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের মতিরহাট ইলিশ ঘাট। যার সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্য
মেহেদী হাসান লিটন। তিনি বলছিলেন, “জেলেদের নিয়ে আমরা যেসব আলোচনা সভা করি, সেগুলোতে চেষ্টা করি জেলেদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করার। এতে জেলে শিশুর সংখ্যা কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে। তবে শিশুদের নদীতে মাছ ধরার কাজে প্রবেশ রোধে সরকারি ও বেসরকারিভাবে জোরালো কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এসব শিশুদেরকে স্কুলে ফেরাতে হলে সে ধরণের পদক্ষেপও নিতে হবে। তাহলেই ওরা জেলে হবে না। দেশ পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে।”
0Share