লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে মেঘনার বুকে জেগে উঠা দুর্গম চরের জমিগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। মেঘনার ভাঙ্গনের শিকার ভিটামাটি হারানো হাজারো মানুষ একটু মাথা গোঁজার জন্য ছুটে যান দুর্গম চরাঞ্চলে। বিশাল অঞ্চল জুড়ে চরাঞ্চলের এসব অনাবাদী জমিকে আবাদী করে তুলতেই প্রভাবশালীদের নজর পড়ে ওইসব জমির উপর। চরাঞ্চলের এসব জমিতে ভূমিহীনদের সরকারিভাবে বন্দোবস্ত দেয়ার কথা থাকলেও পুর্নবাসনের নামে অসাধু ভূমি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ওই ভূমিগুলো চলে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের দখলে।
এদিকে চরের জমিগুলো প্রভাবশালীদের দখলের অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করতে চরে সম্প্রতি পরিদর্শনে যান লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পালসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। জেলা প্রশাসক চরের বাসিন্দা ও ভূমিহীনদের সাথে কথা বলেন। এসময় এসব অসহায় মানুষে মুখে ফুটে উঠেছে আলতাফ হোসেনের জবর দখলের চিত্র।
চর ঘাসিয়া,চর কানিবগা ও চর কাচিয়াসহ কয়েকটি চরাঞ্চল ঘুরে জানা যায়, মেঘনার বুকে জেগে উঠা চরে বসবাস করছেন ভিটেমাটি হারানো লোকজন। এসব লোকজন চরের অনাবাদী জমি চাষাবাদ করে আবাদী করে তুলছেন। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তির যোগসাজশে সরকারের খাস জমি বছরের পর বছর অবৈধভাবে দখল করেছে রায়পুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেনসহ তার অনুগতরা। পরে মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে ভূমিহীনদের কাছ থেকে ইজারা হিসেবে প্রতি একর জমি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করছেন তারা।
রায়পুর উপজেলার চরবংশীর কানিবগার চরে গিয়ে দেখা যায়, এ চরে শিশু-নারীসহ প্রায় ২০ হাজার ভিটেমাটি হারানো মানুষ বসবাস করেন। কথা হয় ভূমিহীন সুলতান মাঝির সাথে। তিনি জানান, নদীভাঙ্গার কারনে গত ১০ বছরে ঠিকানা পরিবর্তন করতে হয়েছে সাতবার। নদী গর্ভে হারিয়েছেন বাপ-দাদার ভিটেমাটি, সেই সাথে হারিয়েছেন প্রিয় মানুষের শেষ স্মৃতি কবরটুকুও। স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে দ্বারে-দ্বারে ঘুরছেন বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু এ দীর্ঘ সংগ্রামে ভূমি অফিস থেকে পাননি এক টুকরো খাস জমিও বন্দোবস্ত। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে রায়পুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন মাষ্টারের কাছ থেকে তিন একর জমি নিয়ে চাষাবাদ ও ওই জমিতে বসবাস করছেন। এর বিনিময়ে প্রতি একর জমির খাজনা বাবত বছরে তাকে দিতে হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অথচ এ সম্পত্তি মেঘনার জেগে উঠা চর। এ খাস সম্পত্তি দখল করে ভূমিহীনদের কাছে ইজারা দেন তিনি। এদিকে প্রতি বছর খাজনা দিতে দেরী হলে উচ্ছেদের হুমকিও দেয়ার কথা জানান এভূমিহীন।
রায়পুর উপজেলা পরিষদের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেনের রয়েছে চরে মফিজ খাঁন,আবুল মাল ও ফারুক ছৈয়ালসহ কয়েকজন অনুগত। চরঘাসিয়া,চরকানিবগা ও চরকাচিয়ায় প্রায় ৫ হাজার একর খাস জমি বছরের পর বছর দখল করে নেয় আলতাফ হোসেন। কোন ভূমিহীন লোকজন এসব বিষয়ে প্রতিবাদ ও কথা বললে নেমে আসে নানা হয়রানী।
জানা যায়, কয়েক বছর ধরে রায়পুরের কানিবগার চর, চরঘাসিয়া ও চরকাচিয়া এলাকার প্রায় ৫ হাজার একর সরকারী খাস জমি বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে দখল করে নেয় প্রভাবাশী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন ও জাকির হোসেন মোল্লাসহ কয়েকজন। অথচ এসব খাস জমি নিয়মানুযায়ী বন্দোবস্ত পাওয়ার কথা নদীভাঙ্গা ভূমিহীন পরিবারগুলোর। এসব খাস জমি ভূমিহীনদের মাঝে বন্টন করার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে প্রভাবশালীরা জেগে উঠা চরাঞ্চলগুলো নিজেরা তা দখল করে নেয়। একই অবস্থায় চরমেঘা, চররমনী মোহন, চরআবদুল্লাহ, তেলিরচর ও বয়াচরসহ ১৫টি চরাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার একর খাস জমি অবৈধভাবে প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। আর বছরে প্রতি একর জমি ইজারা দিয়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে লাখ লাখ টাকা আদায় করে নিচ্ছেন ওই প্রভাবশালীরা।
উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা আলী আহমদ জানান, মেঘনার বুকে জেগে উঠা সরকারি খাস জমি প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। সরকারের এসব সম্পত্তি উচ্ছেদ করতে গেলে প্রভাবাশালীরা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তা বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে এসব চরগুলোতে প্রায় ২ হাজার ৭০০ একর সরকারী খাস সম্পত্তি দখল করে রেখেছে প্রভাবশালীরা।
রায়পুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, চরাঞ্চলের কয়েকশ একর সম্পত্তি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। প্রতিপক্ষরা রাজনৈতিকভাবে তাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে।
জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল জানান, রায়পুরের মেঘনার বুকে জেগে উঠা চরগুলো প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে চরগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে। চরাঞ্চলে সরকারের যে খাস সম্পত্তি প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। তার একটি তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
0Share