জিল্লুর রহমান: কালের সাক্ষী হয়ে এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বয়ে চলছে এককালের খরশ্রোতা ডাকাতিয়া নদী। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখল, দূষণ, নদী ভরাটসহ নানাবিধ অত্যাচার চলছে এই নদীর ওপর। মনুষ্য অনাচারে এই নদীটি যৌবনের স্বর্ণযুগ পার করে এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে। কুমিল্লা, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর, রায়পুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর দৈর্ঘ্য ২১২ কিলোমিটার। বাংলা পিডিয়া এবং উইকিপিডিয়ার মতে, ডাকাতিয়া নদী ভারতের ত্রিপুরা পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, চাঁদপুর হয়ে লক্ষ্মীপুর-রায়পুরের হাজিমারা পর্যন্ত বিস্তৃত। ডাকাতিয়া নদী চাঁদপুরে এসে মেঘনায় মিলিত হয়েছে এবং অন্য একটি অংশ কুমিল্লার গোমতীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ডাকাতিয়া নদী বাম দিকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে ফেনী নদীতে মিশেছে। এই ঐতিহ্যবাহী এবং সমৃদ্ধ নদীটি এখন মৃতপ্রায়। একসময় ডাকাতিয়া নদী ছিল এই অঞ্চলের মিষ্টি পানির সবচেয়ে বড় উৎস। ডাকাতিয়া নদীর ওপর দিয়ে বরিশাল, ভোলা, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মালামাল বহন করা হতো। ডাকাতিয়া বিধৌত অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জীবিকা ও মাছের প্রাকৃতিক নির্ভরশীলতা ছিল এই নদী। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, গত তিন দশকে ডাকাতিয়া নদীকে গলা টিপে হত্যা করেছে এক শ্রেণির নদীখেকো মানুষ। ডাকাতিয়ার দুই তীর ঘিরে এখন চলছে দখলের মহোৎসব। নদীতে নির্বিচারে বর্জ্য নিক্ষেপ, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, কালভার্ট, স্লুইসগেট এমনকি রাস্তা পর্যন্ত নির্মাণের ফলে নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। একই সংগে নাব্যতা সংকটের কারণে নৌ যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে বলা চলে। নদীতে সময়মতো পানি না থাকায় হুমকির মুখে সেচ প্রকল্পগুলো।
অন্যদিকে দীর্ঘ নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে, বিশেষ করে বয়ে যাওয়া সরু নদীতে কাঁচা সুপারি ভেজানোর কারণে পানি বিষাক্ত হয়ে উঠছে। ফলে চিরতরে বিলুপ্ত হচ্ছে অনেক জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী। এসব কারণে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য। মানবসৃষ্ট এই ক্ষতির দায় মানুষকেই নিতে হবে। প্রকৃতিগতভাবেই নদীর ধর্ম হলো বহমানতা, কোনো সীমারেখা দিয়ে নদীকে আটকানো ঠিক নয়, এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিবেশ আইনকেও মানছে না কেউ।
ডাকাতিয়া নদী যুগের পর যুগ থেকে আমাদের জীবন ও জীবিকার জোগান দিয়েছে। মায়ের কোলে যেমন শিশুর আশ্রয়, তেমনি ডাকাতিয়াও আমাদের আশ্রয় ছিল। ডাকাতিয়ার বাস্তবতাকে অস্বীকার করে আমাদের অস্তিত্ব কল্পনা করা হবে আত্মহত্যার শামিল।
আমরা প্রবলভাবে বিশ্বাস করি এবং গবেষণা বলে, বর্তমান মৃত ডাকাতিয়ার যৌবন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমরা যদি নাব্যতা সৃষ্টি এবং অবৈধ বাঁধ উচ্ছেদ করে ডাকাতিয়ার স্বাভাবিক পানিপ্রবাহকে অবাধ করতে পারি, তাহলে নদী তার হারানো যৌবন ফিরে পাবে। শুধু তাই নয়, নদীতে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন নিশ্চিত করলে দেশের মাছের চাহিদার ১০ ভাগ মেটানো সম্ভব।
এতে ব্যবস্থা পুনরায় সচল হলে বাড়বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সূচনা হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত। এবং যোগাযোগব্যবস্থা পুনরায় সচল হলে বাড়বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সূচনা হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত।
এই অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের সহযাত্রী এখনই সময়, ডাকাতিয়া নদীকে বাঁচিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের রক্ষা করার। আসুন আমাদের অস্তিত্বের অন্যতম এই সহযাত্রীকে আমাদের স্বার্থেই বাঁচিয়ে তুলি। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ডাকাতিয়ার পাশে দাঁড়াই। বেঁচে উঠবে ডাকাতিয়া নদী। এখনই সময়, ডাকাতিয়া নদীকে বাঁচিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের রক্ষা করার। আসুন আমাদের অস্তিত্বের অন্যতম এই সহযাত্রীকে আমাদের স্বার্থেই বাঁচিয়ে তুলি। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ডাকাতিয়ার পাশে দাঁড়াই।
লেখক : সংবাদকর্মী ও সদস্য সচিব, ডাকাতিয়া সুরক্ষা আন্দোলন।
0Share