লোকসংগীত শিল্পী হায়দার আলী বয়াতি আর বেঁচে নেই (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮৫ বছর। অসুস্থ অবস্থায় বুকে ব্যাথা অনুভব করে বুধবার (২৮ জুলাই) ভোরে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার গাইয়ার চরগ্রামে নিজ বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পারিবারিক ভাবে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
হায়দার আলী বয়াতি দীর্ঘদিন হার্ট ও কিডনি রোগে ভুগছিলেন বলে জানিয়েছেন,তাঁর নাতি মোঃ আনোয়ার। গত পাঁচ-ছয় বছর যাবত তাঁর জীবন কেটেছে খুব অভাব অনটনে। সে কারণে উন্নত চিকিৎসা করানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে ও নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
হায়দার আলী বয়াতি গান লিখে গাইতেন না, তাৎক্ষণিক গান তৈরি এবং গেয়ে ভক্ত-শ্রোতাদের মন জয় করার দারুণ ক্ষমতা ছিল তার। লক্ষ্মীপুর ও বৃহত্তম নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের হাট-বাজার ও গ্রামীণ জনপদে জারি-সারি, শরিয়তি-মারফতি, পীর মুর্শিদি, আল্লাহ-নবীর গুণগান গেয়ে অসংখ্য গান গেয়েছিলেন। পালাগান ও কবি গানের লড়াই দিয়ে তিনি ভক্ত-দর্শক-শ্রোতাদের মন জয় করতেন। লক্ষ্মীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর অনেক শ্রোতা ও ভক্ত রয়েছে।
হায়দার আলী বয়াতি ১৯৩৭ সালের ৫ জুলাই লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চর আবাবিল ইউনিয়নের গাইয়ারচর গ্রামের কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তার বাবার নাম ছেলামত উল্লাহ পাটওয়ারীর । হায়দার আলী বয়াতির পারিবারিক নাম ছিল মো. আলী হায়দার পাটওয়ারী । কিন্ত হায়দার আলী বয়াতি নামেই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন।
জাতীয় শিশুকিশোর সংগঠন খেলাঘর লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সাংবাদিক শংকর মজুমদার জানান, কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণকারী হাযদার আলীর শৈশব কাটে গাইয়ার চর গ্রামে। লেখাপড়ার প্রতি তেমন আগ্রহ না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষাসম্পন্ন করতে পারেননি। শৈশব থেকেই গান বাজনার প্রতি ঝোক ছিলো তাঁর। কন্ঠ ছিলো সুমধুর। যে কোন গান একবার শুনলেই তা হুবহু গাইতে পারতেন। সুর-সংগীতের মোহে মাত্র ১১ বছর বয়সে এলাকায় অনুষ্ঠিত এক কবিগানের আসরে জনৈক কবিয়ালের সাথে ভাব জমিয়ে ওই দলের সাথে যুক্ত হয়ে বাড়ি ছাড়া হন।
পরে বয়াতি গানের দলের সাথে দেশের বিভিন্ন হাট-বাজার, শহর-বন্দর ও গ্রামীণ জনপদে জারি-সারি, পালাগান ও কবি গান গেয়ে ঘুরে ফিরতেন।
দীর্ঘ ২৩ বছর পর আবার বাড়ি ফিরে আসেন কবিয়াল হায়দার আলী। দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ থাকায় বাড়ি আসার পর স্বজনরা তাঁকে জোর করেই বিয়ে দেন। এতে তাঁর বাউন্ডুলে জীবনের অবসান হলেও গান ছেড়ে দেননি। ২০১৬ সাল পর্যন্ত টানা গান গেয়ে ছিলেন। এসময় তাঁর অসংখ্য শিষ্য তৈরি হয়। ২০১৬ সালের পর তাঁর শরীরের নানা রোগ দেখা দেয়। সংসারে উপার্জনশীল কোন লোক না থাকায় দীর্ঘদিন তাঁর জীবন কাটে অভাব অনটনে।
লক্ষ্মীপুর জেলার লোকজ সংস্কৃতির একজন গুণী শিল্পী হিসেবে কবিয়াল হায়দার আলী বয়াতিকে ২০১৬ সালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে সম্মানসূচক পুরস্কার প্রদান করা হয়।
২০১৭ সালে সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়ের দুুঃস্থ সাংস্কৃতিক শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে হতে এককালীন ১৪ হাজার টাকা সরকারি ভাতা পেয়েছিলেন।
বাংলা একাডেমির মাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা : লক্ষ্মীপুর গ্রন্থে হায়দার আলী বয়াতীকে একটি নিবন্ধন লিখেছিলেন, প্রফেসর মাইন উদ্দিন পাঠান।
লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা : লক্ষ্মীপুর গ্রন্থের লেখক প্রফেসর মাইন উদ্দিন পাঠান বলেন, ‘হায়দার আলী বয়াতি গুণী শিল্পী ছিলেন। তিনি গান লিখে গাইতেন না, তাৎক্ষণিক গান তৈরি ও গেয়ে ভক্ত-শ্রোতাদের মন জয় করার দারুণ ক্ষমতা ছিল তার।’
0Share