নিজস্ব প্রতিনিধি, লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর | বিএনপির সমাবেশে যোগদানের পর বাড়ি ফেরার পথে আওয়ামীলীগের লোকেরা যুবদল কর্মী আব্দুল মান্নান চুট্টু-র উপর বর্বরোচিত হামলা চালায়। তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৪২টি কোপ দিয়ে নির্মমভাবে হত্যার চেষ্টা করে। সে ঘটনায় দীর্ঘ ৬ মাস আইসিইউতে এবং প্রায় ২ বছর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে তিনি প্রাণে বেঁচে যান । তবে তার এ বেঁচে থাকা অন্যের উপর ভর করে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বাড়িতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
লক্ষ্মীপুরের হাজিরপাড়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড মুসলিমাবাদ গ্রামের আবদুর রশিদের ছেলে ও সাবেক ইউনিয়ন যুবদল সদস্য আবদুল মান্নান চুট্টোর এমন মানবেতর জীবনযাপন নিয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোরের ওয়েব ভার্সন এবং ১৭ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোরের ডিজিটাল ভার্সনে দুটি পৃথক সংবাদ প্রকাশিত হয়।
সংবাদগুলো দেখে দেশ বিদেশের অসংখ্য মানুষ আবদুল মান্নান চুট্টোর খবর নিতে লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর ও চুট্টোর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে। সংবাদ দুটি দেখে সৌদি আরব অবস্থানরত বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী তাৎক্ষণিক বিএনপির নেতা কর্মীদের ওই বাড়িতে পাঠায়। তারা ভিডিও কলে শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির সাথে চুট্টোর কথা বলিয়ে দেন। এসময় এ্যানি বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চুট্টুর খবরটি দেখেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন দলীয়ভাবে আবদুল মান্নান চুট্টুর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার জন্য। অন্যদিকে আগামী ২১ সেপ্টেম্বর শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি দেশে ফিরেই প্রথমে চুট্টুকে দেখতে তার বাড়িতে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে একই খবর দৃষ্টিগোচর হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না’র। তিনি স্থানীয় লক্ষ্মীপুর জেলা যুবদল’কে চুট্টুর সার্বিক খোঁজখবর নিয়ে জরুরী ভিত্তিতে জানানোর নির্দেশনা প্রদান করেন।
কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মতে যুবদলের জেলা ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা শুক্রবার দুপুরের আব্দুল মান্নান চুট্টুর গ্রামের বাড়িতে দেখতে ও খোঁজ নিতে যান।
এসময় উপস্থিত ছিলেন, লক্ষ্মীপুর জেলা যুবদলের সদ্য সাবেক সভাপতি ও লক্ষ্মীপুর পৌর বিএনপির সভাপাতি রেজাউল করিম লিটন, লক্ষ্মীপুর জেলা যুবদলের সভাপতি আবদুল আলী হুমায়ুন, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ রাশিদুল হাসান লিংকন, লক্ষ্মীপুর পৌর যুবদলের আহ্বায়ক ফয়েজ আহমদ, চন্দ্রগঞ্জ থানা যুবদলের আহ্বায়ক এনায়েত উল্লাহ, সদস্য সচিব আবদুল মুকিত সোহেল, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল মালেক মেম্বার, সদর পূর্ব যুবদলের সদস্য সচিব কাজী বেল্লাল হোসেন, লক্ষ্মীপুর পৌর যুবদলের দপ্তর সম্পাদক আবদুল আজিজ মিশু, চন্দ্রগঞ্জ থানা যুবদল ও ছাত্রদলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
স্থানীয় ভাবে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের হাজিরপাড়া ইউনিয়নের মুসলিমাবাদ গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন যুবদল সদস্য আবদুল মান্নান চুট্টো । যিনি স্থানীয়ভাবে “আবদুল মান্নান বিএনপি” নামেও পরিচিত। এক সময় দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতা হিসেবে এলাকায় সবার কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৬ সালে বিএনপির মিছিলে যোগদানের অপরাধে আওয়ামীলীগের কর্মীদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তার শরীরে রয়েছে ৪২ কোপের দাগ।
মান্নানের বড় ভাই মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন জানান, ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে ঢাকার শানারপাড়ে বিএনপি আয়োজিত একটি কর্মসূচি থেকে বাড়ি ফেরার পথে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাকে মারাত্মকভাবে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে যায়।
তার শরীরে রয়েছে ৪২টি কোপের দাগ। ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে, পরে মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ার ইউরোপ বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখানে তিনি তিন মাস লাইফ সাপোর্টে ও ছয় মাস হাসপাতালে থেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছেন। চিকিৎসায় তখন প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় হয় বলে পরিবারের সদস্যরা জানান।
গিয়াস উদ্দিন বলেন, একসময় যুবদলের সক্রিয় সদস্য থাকলেও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও হামলার কারণে দীর্ঘদিন এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন মান্নান। ঢাকার শানারপাড় এলাকায় ভাইদের সঙ্গে থাকাকালীন তিনি হেলপার ও পরে ড্রাইভিং পেশায় যুক্ত হন। একইসঙ্গে বিএনপির বিভিন্ন কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। রাজনৈতিক পরিচয় দিয়েই চলাফেরা করতেন ।
ভয়াবহ ওই হামলার পর তার জীবন নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। বর্তমানে তিনি শয্যাশায়ী। বিছানায় বসেই দিন কাটান। খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুর জন্য এখন অন্যের ওপর নির্ভরশীল। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রথমদিকে তার স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান পাশে থাকলেও পরবর্তীতে স্ত্রী অন্যত্র চলে যান এবং সন্তানের দায়িত্বও আর নেননি। এখন গ্রামের এক প্রবীণ ব্যক্তি ও এক চাচাতো ভাইকে মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতনে তার দেখাশোনার জন্য রাখতে হচ্ছে। মান্নান এখনো নিজে খাবারও খেতে পারেন না, হাতে তুলে দিতে হয়।
মান্নানের বড় ভাই মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, “আমরা ঢাকায় থাকি বলে সবসময় তার পাশে থাকতে পারি না। আমাদের সাধ্যমতো চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু অর্থাভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তার অবস্থা খুবই করুণ। দলের জন্য জীবন ঝুঁকিতে ফেলে মিছিলে যোগ দিয়েছিল। আজ সেই দলের কোনো নেতাকর্মী তাকে দেখতে আসে না।”
স্থানীয়রা জানান, একসময় তিনি ছিলেন এলাকার তরুণদের প্রেরণা। কিন্তু আজ রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দলের পক্ষ থেকেও তেমন কোনো সহায়তা আসেনি।
দলের পক্ষ থেকে সহানুভূতি বা সহায়তা না পাওয়ায় মান্নানের পরিবার গভীর হতাশায় ভুগছে। এই রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় আজও মামলা হয়নি বলে পরিবার জানায়।
স্থানীয় কয়েকজন নেতাকর্মী জানয়েছেন, একসময় যিনি ছিলেন দলের একনিষ্ঠ সৈনিক, সেই আবদুল মান্নান চুট্টো এখন রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে পরিত্যক্ত ও অসহায় জীবনযাপন করছে। এটি দলের জন্যও এক বিব্রতকর বাস্তবতার প্রতীক।
0Share