বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের ভেতরে দু’টি গ্রুপের দ্বন্দ্ব চলছে বেশ কিছুদিন ধরে – যা সহিংস রূপ নিয়েছে শনিবারের সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে । এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে আছেন তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা ভারতীয় মোহাম্মদ সাদ কান্দালভি।
এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই ঢাকার টঙ্গীতে এবার বিশ্ব ইজতেমা হতে পারেনি।
তাবলীগ জামাতের একটি গ্রুপ ১১ই জানুয়ারি থেকে ইজতেমা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত মাসে তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপকে নিয়ে বৈঠক করেন – যেখানে ওই তারিখে ইজতেমা না করার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু সাদ কান্দালভি কি করেছেন বা বলেছেন – যা নিয়ে এই বিভক্তি?
বেশ কিছু কাল ধরেই মি. কান্দালভি তাবলীগ জামাতে এমন কিছু সংস্কারের কথা বলছেন – যা এই আন্দোলনে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।
সাদ কান্দালভি বলেন, ‘ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়” – যার মধ্যে মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকান্ড পড়ে বলে মনে করা হয়।
সাদ কান্দালভি আরো বলেন, “মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদ্রাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত – যাতে মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়ে।”
কিন্তু তার বিরোধীরা বলছেন, সাদ কান্দালভি যা বলছেন – তা তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের নির্দেশিত পন্থার বিরোধী
তাদের বক্তব্য, মি. কান্দালভির কথাবার্তা আহলে সুন্নাত ওয়া’ল জামাতের বিশ্বাস ও আকিদার বাইরে।
কিন্তু মি. কান্দালভির সমর্থকরা বলছেন,তাদের নেতার বক্তব্য বা সংস্কারের প্রস্তাব মানতে না পেরেই বাংলাদেশে সংগঠনটির কর্মকান্ডকে ‘রাজনৈতিক চেহারা’ দেয়া হয়েছে।
তবে সাদ কান্দালভির বিরোধী একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতার মতে, সাদ কান্দালভি এখনো এ মতবাদ ছাড়েন নি। “তাই এটা যেন বাংলাদেশে ছড়াতে না পারে এবং মুসলিমরা যেন পথভ্রষ্ট না হয়, সে জন্য তারা কাজ করে চলেছেন।”
তিনি দাবি করেন, এর মধ্যে এক কণাও রাজনীতি নেই।
ভারতীয় উপমহাদেশে সুন্নি মুসলমানদের বৃহত্তম সংগঠন এই তাবলীগ জামাতের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্য রূপ পায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে – যখন তাদের মূল কেন্দ্র কাকরাইলে দুই দল কর্মীর মধ্যে হাতাহাতি হয়।
এর পর এ বছর জুলাই মাসে ঢাকায় কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমীর শাহ আহমদ শফী’র উপস্থিতিতে তাবলীগ জামাতের একাংশের এক সম্মেলন হয় । এতে সাদ কান্দালভিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় – দিল্লিতে তাবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাদ কান্দালভির বক্তব্য ও মতবাদকে অনুসরণ করা হবে না, এবং আগামী বিশ্ব ইজতেমার সময় তাকে বাংলাদেশে আসতেও দেয়া হবে না।
তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভির এসব চিন্তাভাবনা নিয়ে তাবলীগ জামাতের দু’টি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের প্রভাব গত ইজতেমাতেও পড়েছিল।
সে সময় এ নিয়ে এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে – যখন মি. কান্দালভি বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে ঢাকায় এসেও ইজতেমা প্রাঙ্গণে যেতে পারেন নি।
মি. কান্দালভি তার বিরোধী পক্ষের প্রতিবাদের মুখে ঢাকায় তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় কাকরাইল মসজিদ অবস্থান নেন, এবং পরে সেখান থেকেই দিল্লী ফেরত যান।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী এখনো তবলীগ জামাতের প্রধান দফতর কাকরাইল মসজিদেই অবস্থান করছেন, কিন্তু কার্যক্রম চালাচ্ছেন আলাদা আলাদা ভাবে।
মি. কান্দালভির সমর্থক গোষ্ঠীর একজনের মতে, তাবলীগ জামাতের ৯০ শতাংশই ‘নিজামুদ্দিন মারকাজ’ বা সা’দ কান্দালভি-র অনুসারী হিসেবেই আছেন। কিন্তু তার কিছু কথাকে একটি গোষ্ঠী সহজভাবে নিতে পারছেন না।
তার বিরোধীদের পেছনে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের লোকেরা সক্রিয় বলে বলা হলেও – হেফাজতের নেতারা এ অভিযোগ সরাসরি স্বীকার করেন না।
হেফাজতে ইসলামের একজন উর্ধতন নেতা মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এখানে হেফাজত বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
এ বিরোধ এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের তাবলীগ জামাতের অনুসারীদের মধ্যে। ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তাবলীগ জামাতের নেতৃত্বের বিভক্তি দেখা দিয়েছে অনেকদিন আগেই।
বিরোধ মেটানোর চেষ্টা থাকলেও তাতে এখনো ইতিবাচক ফলাফল দেখা যাচ্ছে না।
0Share