সানা উল্লাহ সানু : গতবছরের ডিসেম্বের থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত হঠাৎ করেই মেঘনা নদীতে ব্যাপক হারে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। প্রতি রাতেই দুই থেকে তিনটি লাইটার জাহাজে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। ডাকাতদের আক্রমণে নাবিক ও কর্মচারীরা আহত হচ্ছেন। জাহাজের মালামাল লুট করে নিচ্ছে তারা। এসময় বিভিন্ন জাহাজের অন্তত ২৫ জন নাবিক ও কর্মচারীকে কুপিয়ে আহত করেছে ডাকাতদল। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন, বাংলাদেশ লাইটার জাহাজ শ্রমিক ইউনিয়ন এবং কয়েকজন নাবিকের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
হঠাৎ করে বেপরোয়া নৌ ডাকাতি (জলদস্যুতা) বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে- গত ১৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি লিখে ঘটনার ভয়াবতা জানিয়েছে বাংলাদেশ লাইটার জাহাজ শ্রমিক ইউনিয়ন। নৌ শ্রমিকদের আরেকটি প্রতিষ্ঠান– বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়ার জন্য তথ্য সংগ্রহ করছে।
চিঠিতে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করে ১২টি বড় ডাকাতি ও অপহরণের ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, গত একমাসের ডাকাতির ঘটনার ডেটাবেজ তৈরির জন্য ফেসবুকে তথ্য চেয়ে পোস্ট করেছে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন। ওই পোস্টের বিপরীতে, বিভিন্ন জাহাজের নাবিক ও মাস্টাররা ডাকাতির তথ্য দিয়েছেন। এতে দেখা গেছে, গত একমাসের ব্যবধানে মেঘনার জলসীমায় অন্তত ২৫টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ডাকাতির ঘটনার প্রত্যক্ষ বর্ণনা দিয়েছেন নৌযান শ্রমিকরা।
নাবিকদের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, গত এক মাসে চাঁদপুরের মাইজের চর এবং লক্ষ্মীপুর ও ভোলা জেলার মধ্যবর্তী মেঘনা নদীর মাইজের চরে সবচেয়ে বেশি ডাকাতি হয়েছে। মাইজের চরে অন্তত ১০টি ডাকাতির ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন শ্রমিকরা। মাইজের চর ছাড়াও– ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর, মেঘনাঘাট, চাঁদপুরের ষাটনল, বরিশাল, ভোলা ও লক্ষ্মীপুরের সীমান্তবর্তী মেহেন্দিগঞ্জ এবং ইলিশা, কালিগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরের চর আবদুল্লাহ, নোয়াখালীর বয়ারচর এলাকায় বর্তমানে ডাকাতরা বেপরোয়া। যা পুরোটাই মেঘনার জলসীমা। প্রতিটি নৌযানে ডাকাতির সময় নৌযানের শ্রমিকদের আহত করে ডাকাতরা।
এমভি প্রাইড অব খানজাহান আলী-৪ নামের একটি লাইটার জাহাজের কর্মচারী আরিফুল ইসলাম জানান, ১১ জানুয়ারি তাদের জাহাজটি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। রাত সাড়ে আটটার দিকে লক্ষ্ চাঁদপুরের সীমান্তবর্তী মাঝের চরের অতিক্রম করার সময় প্রায় ২৫ জনের একটি ডাকাত দল তাদের জাহাজ আক্রমণ করে। ডাকাতদের সাথে ছিল ৪টি বন্দুক ও দেশীয় ধারালো অস্ত্রশস্ত্র। ডাকাতরা জাহাজ থেকে নগদ ৩২ হাজার টাকা, নাবিকদের মোবাইল ফোন, জামা-কাপড়, জাহাজের তেল, বাজার-সদাই এবং জিপিএস নিয়ে যায়।
একই সময়ে এমভি প্রিন্স অব ঈশান জাহাজেও ডাকাতি হয় বলে জানিয়েছেন জাহাজের মাস্টার আল আমিন।
এমভি আল মোস্তফা-২ এর নাবিক মেজবাহ উদ্দিন জানিয়েছেন, তাঁর জাহাজটি গত ১৪ নভেম্বর তারিখে মাইজের চরের নিকট ডাকাতদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। মো. খাইরুল ইসলাম নামে আরেকজন জানিয়েছেন, ১৫-১৬ তারিখ দুই দিনে একই স্থানে ৪টি জাহাজে ডাকাতি হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) গজারিয়ায় ডাকাতির কবলে পড়ে আনোয়ার মেরিটাইম-৫ জাহাজ। এরপর ওই জাহাজের মাস্টার মো. নূর নবীসহ ১২টি জাহাজের নাবিকরা তাদের জাহাজগুলোর নিরাপত্তা চেয়ে– মালিক প্রতিষ্ঠান আনোয়ার সিমেন্ট কোম্পানির কাছে লিখিত আবেদন করেন।
মেঘনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে এমন ভয়াবহ আকারের ডাকাতির ঘটনায় নৌযান শ্রমিকদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ লাইটার জাহাজ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. মিজানুর রহমান জানান, “সারা বছরই নদীতে ডাকাতি হয়। তবে গত একমাসে যে হারে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে, তা এক ধরনের নৈরাজ্য। আমরা স্থানীয় প্রশাসনে এখন আর আস্থা রাখতে পারছি না। তাই আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। যদি নৌ পথ নিরাপদ না করা হয়, তবে আমরা ধর্মঘটে যাব।”
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন এর সভাপতি মো. শাহ আলম ভুইঁয়া জানান, “হঠাৎ করে এত বেপরোয়া নৌ ডাকাতিতে আমরা আতংকিত। মুক্তারপুর এলাকায় তিনটি নৌ পুলিশের ইউনিট থাকা সত্ত্বেও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। আমরা সারাদেশ থেকে তথ্য নিচ্ছি, এরপর বিষয়টি লিখিতভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাব। নাবিকরা নিরাপত্তা না পেলে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিবে।”
নদীতে হঠাৎ বেপরোয়া জলদস্যুতার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নৌ পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) শফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “শুধু আমরাই উপকূলের প্রহরী নই, অন্যান্য সংস্থাগুলোও রয়েছে। তাদেরও উপকূল পাহারা দেওয়া এবং জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব রয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর বিষয়ে আমরা কোনও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। ডাকাতির এ তৎপরতায় কিছু বিরোধী-গোষ্ঠীও জড়িত বলেও ইঙ্গিত দেন পুলিশের এ কর্মকর্তা।
“জাহাজ ভাড়া এবং অন্য কিছু আর্থিক সমস্যার কারণেও এমনটি ঘটে,” বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সংবাদটি ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাড থেকে অনুবাদকৃত।
0Share