লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর: পরিবার ও প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সময়ের অভাবে তা আর হয়ে উঠে না। কিন্তু ঈদ অনেককে যেন সেই সুযোগই করে দিয়েছে। তাই তারা এখন প্রিয়জন ও সপরিবারে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়াতে বের হচ্ছেন। লক্ষ্মীপুরবাসীর জন্য সেই সুযোগ অবারিত করেছে মেঘনা নদী। মেঘনার ভাঙ্গনে হাজারো মানুষের ভিটে বাড়ি চলে গেলেও ইলিশ দিয়ে সেই ক্ষত যেন অন্যভাবে পুষিয়ে নিচ্ছে এ উপকূলবাসী। এর মাঝে উপকুলবাসী এবার মেঘনাকে পেতে যাচ্ছে নতুন এক পর্যটন শিল্প হিসেবে। লক্ষ্মীপুরের নতুন পর্যটন এলাকা কমলনগরের মতিরহাট।
প্রতি ঈদের ছুটিতে হাজারো তরুণ-তরুণীসহ দেশি পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত মতিরহাট ও তার আশে পাশের মেঘনার তীর এবং নদীর বুকে ভাসমান দীর্ঘ চর।
অনেকে পরিবার পরিজন নিয়ে এসে একবার হলেও মতিরহাট ঘুরে যাচ্ছেন। এখানে প্রতিনিয়ত দেখা মিলছে জেলে পরিবারের অদ্ভুত জীবন-যাপনের সারি সারি নৌকা।
খুব কাছে থেকে দেখা মিলবে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ২১টি জেলা যানবাহন ও লোকজন উক্ত রুটে রোঁ রোঁ ফেরি এবং সি-ট্রাকে লক্ষ্মীপুর সদর হয়ে এসে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের দৃশ্য । মতিরহাটে অদূরে জেগে ওঠা চরসমূহে দেখা মেলে হরেক রকমের দেশী বিদেশী হাঁস ও বকসহ নানান জাতের পাখির ঝাঁক। তবে সেটা শীত মৌসুমে।
ভাসমান চরে রয়েছে শতশত মহিষ ও ভেড়ার পাল। শত শত ছোট বড় নৌকা, ট্রলার নিয়ে নারী পুরুষের জোট বেঁধে চোখ ধাঁধানো রূপালী ইলিশ ধরার দৃশ্য। দেখা যাবে দুর্যোগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চরের মানুষের কষ্টকর জীবন-যাপন।
নদীর কূল ঘেঁষে ছোট শিশুদের শীত, গ্রীষ্মকে উপেক্ষা করে ক্লান্তিহীন দলবদ্ধভাবে সিরিং মাছ, চিংড়ি পোনা আহরণের দৃশ্য। চোখে পড়বে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নৈসর্গিক দৃশ্য। বর্তমানে এ দৃশ্য উপভোগের জন্য নারী-পুরুষ-শিশুরা দলবদ্ধভাবে মতিরহাটে ভিড় জমাচ্ছে।
অপরদিকে ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে নদীতে ঘুরে ফিরে নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকন করে। নদীতে বেদে জেলের নৌকার বহর। নৌকাতে পুরো পরিবার নিয়ে এরা নদীতে বাস করছে।
মতিরহাট পর্যটকদের আকর্ষণের কারণ কি এমন প্রশ্নের জবাবে মতিরহাট পর্যটন ঘাটের মাঝি বাসার জানান, এখানে রয়েছে মেঘনার বিশাল জলরাশি, আছে রুপালি ইলিশ সাথে হরেক রকম সামুদ্রিক মাছ, সবচেয়ে বড় আর্কষণ চরের মাটিতে ঘুরের বেড়ানো।
এখানে রয়েছে হাজার হাজার মহিষ আর ভেড়ার পাল। চরের মাঝে উচু উচু টং ঘরগুলো যেন অন্য এক স্বাদ লক্ষ্মীপুরে এনে দিয়েছে। চরের মাটিতে তাজা চিড়িং কিংবা ভাটা মাছ নিজ হাতে ধরতে এখানে চরের ঘুরে যেতে পারেন কিংবা নিয়ে যেতে পারেন কমলনগরের বিখ্যাত মহিষের দই। আর ঘাটে ঘুরলে একেবারে তাজা বরফ এবং ফরমালিনমুক্ত সামুদ্রিক মাছ কিনতে পারেন। তবে এবার এখন চলছে ইলিশ ধরার নিষিদ্ধ সময়। তাই মাছ কেনা যাবে না ।
মজুচৌধুরীরহাট:
সদর উপজেলার মজুচৌধুরীর হাটে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র। বরিশাল-ভোলা-লক্ষ্মীপুর মহাসড়কে জেলা সদর থেকে প্রায় ১১ কি.মি অদূরে ঐতিহ্যবাহী মজু চৌধুরীহাট প্রকাশ মৌজ্জারহাট। মতিরহাটে যা যা দেখা যায় তার সব কিছুই রয়েছে মজুচৌধুরীর হাটে।
তবে বাড়তে রয়েছে মহাসড়কের দু’ধারে সাজানো সারি সারি ঝাউ গাছসহ নানান জাতের বৃক্ষের গড়া ফটক। মহাসড়কের দু’ধারে রয়েছে নারিকেল সুপারি সাজানো গছানো বাগান। নয়ন জুড়ানো মৌসুমী মাঠভরা ফসলী মাঠ। এতে মন ও শরীরের ক্লান্তি কিছুটা হলেও দূর হবে। সাধারণ লোকের কাছে মৌজ্জারহাট নামে অধিক পরিচিত।
জেলা শহরের মাঝখান দিয়ে শত বছরের এককালীন প্রবহমান রহমতখালী নদীটি মৌজ্জারহাটে এসে দেশের প্রধান নদী মেঘনায় মিলিত হয়েছে। মেঘনার সেখানে আরও মিলিত হয়েছে ডাকাতিয়া নদী। মূলত এটি হচ্ছে দেশের বৃহত্তর মেঘনার মোহনা।
সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী আ.স.ম আব্দুর রব জানিয়েছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ মোহনা হচ্ছে মেঘনার মোহনা। চাঁদপুর জেলার ষাটনল লক্ষ্মীপুর জেলার আলেকজান্ডার পর্যন্ত প্রায় এক শ’ কি মি মেঘনার মোহনা বিস্তৃত।
এ মোহনা হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচলের একমাত্র মাধ্যম। সমগ্র বাংলাদেশে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নৌ-চলাচলের জন্য উক্ত চ্যানেল ব্যতীত অসম্ভব। প্রতিদিন উক্ত চ্যানেলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক শত শত জাহাজের সারিবদ্ধ চলাচল করতে দেখা যায়।
এটি হচ্ছে তৎকালীন লক্ষ্মীপুর মহকুমা সদরের চররমণীমোহন মৌজার একটি অংশ। ১৯৭০ এ পাক সরকারের বিদায় লগ্নে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হিসেবে লক্ষ্মীপুরে পরিদর্শনে আসেন। ক্ষমতায় না থেকেও তিনি তখন বন্যা থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষার জন্য মৌজ্জারহাটে রেগুলেটর নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন।
স্বাধীনতার পর পরই বন্যাকবলিত এ অঞ্চলের মানুষকে নিরাপদে থাকার জন্য তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩ ব্যান্ডের রেগুলেটর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ১৩ ব্যান্ডের উক্ত রেগুলেটরটি উদ্বোধন করেন।
এরপর থেকে এ অঞ্চলের মানুষ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পায়। একই সঙ্গে এলাকাটির গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। সেখানে স্থায়ী নৌ-ঘাট স্থাপিত হয়। জেলার অভ্যন্তরীন ভাগে নেভিগেশন ব্যাহত হওয়ায় এরপর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ২০০০ সালে প্রায় ২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪ ব্যান্ডের অপর আরেকটি নেভিগেশন লক তৈরি করা হয়।
ওই বছরে পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক উক্ত রেগুলেটরটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। যার ফলে এটির গুরুত্ব আরও অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। দু’টি রেগুলেটর প্রায় পাশাপাশি অবস্থিত। রেগুলেটরটির পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে লঞ্চঘাট ও ফেরিঘাট।
এখানে পৌঁছার একটু আগে পথিমধ্যে দেখা যাবে আধুনিক কারুকার্য খচিত মটবী দায়রা শরীফের চোখ ধাঁধানো প্রশাসনিক বিশাল আকারের ভবন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে উঠেছে বিভিন্ন ফুল ফল ও সুদৃশ্য গাছের বাগান।
জেলা সদর বাস থেকে শুরু করে সড়ক পথে যে কোনো সহজ সেখানে কম খরচে পৌঁছানো সম্ভব।নৈসর্গিক বিভিন্ন দৃশ্যের উপভোগের সুযোগ থাকলেও সেখানে গড়ে ওঠেনি পর্যাপ্ত অবকাঠামো, হোটেল-মোটেল এবং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা।
0Share