লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর প্রতিবেদক:
শরিফ ওসমান বিন হাদি। যিনি ওসমান হাদি নামে সমধিক পরিচিত । ছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির এক উদীয়মান তরুণ নেতা, রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা। ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী আন্দোলনের একজন সোচ্চার কণ্ঠস্বর এবং ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর মুখপাত্র হিসেবে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। তার স্পষ্টভাষী বক্তব্য, অভিনব রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং প্রচলিত ধারার রাজনীতির কঠোর সমালোচনা তাকে দ্রুত আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে তার হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং এর রাজনৈতিক তাৎপর্য তাকে এক ট্র্যাজিক বিপ্লবীর প্রতীকে পরিণত করে।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
ওসমান হাদি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষক ও স্থানীয় ইমাম । ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। হাদির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয় নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায়। পরবর্তীতে তিনি ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। রাজনীতিতে পূর্ণাঙ্গভাবে সক্রিয় হওয়ার পূর্বে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন; প্রথমে ইংরেজি শেখার একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে এবং সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস-এ শিক্ষকতা করেন। এই শিক্ষাগত পটভূমি ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা তার রাজনৈতিক দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, যা তাকে তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে এসে একজন চিন্তাশীল নেতায় পরিণত হওয়ার ভিত্তি গড়ে দেয়।
রাজনৈতিক জীবনের সূচনা: জুলাই বিপ্লব
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ছিল ওসমান হাদির রাজনৈতিক জীবনের সূচনালগ্ন। এই আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকার রামপুরা এলাকায় একজন স্থানীয় সংগঠক ও সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । তার সাংগঠনিক দক্ষতা তাকে ছাত্র-জনতার মাঝে পরিচিত করে তোলে। এই অভ্যুত্থানের পর যে নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনা হয়, হাদিকে তার অন্যতম তরুণ স্থপতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রামপুরার স্থানীয় সমন্বয়ক হিসেবে অর্জিত এই অভিজ্ঞতা ও পরিচিতিই তাকে জাতীয় রাজনীতিতে এক প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথ তৈরি করে দেয়।
রাজনৈতিক উত্থান ও প্রধান কর্মকাণ্ড
জুলাই বিপ্লবের পর ওসমান হাদি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে দ্রুত নিজের স্থান করে নেন। তার কার্যক্রম ছিল বহুমাত্রিক, যা তাকে একাধারে সংগঠক, সমালোচক ও পরিবর্তনের দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ইনকিলাব মঞ্চ: আদর্শ ও লক্ষ্য
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার দাবি ও আকাঙ্ক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ওসমান হাদির নেতৃত্বে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম। সংগঠনটির মূল লক্ষ্যগুলো ছিল:
• সকল প্রকার আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা।
• “ইনসাফভিত্তিক” বা ন্যায়বিচারমূলক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
• গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও ন্যায়বিচারকে রাষ্ট্রের প্রধান মূল্যবোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
• জুলাই অভ্যুত্থানে আহত-নিহত ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান এবং জুলাই চার্টার ঘোষণার দাবি উত্থাপন।
রাজনৈতিক অবস্থান
ওসমান হাদি বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে তার দৃঢ় ও স্পষ্ট অবস্থানের জন্য পরিচিত ছিলেন। তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান নিচে তুলে ধরা হলো:
|
বিষয়
|
হাদির অবস্থান ও কর্মকাণ্ড
|
|
আওয়ামী লীগ নিষেধাজ্ঞা
|
আওয়ামী লীগকে “সন্ত্রাসী সংগঠন” হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন এবং এই দাবি না মানা হলে সচিবালয় ঘেরাওয়ের মতো কঠোর কর্মসূচির হুমকি প্রদান।
|
|
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
|
সরকারের কাঠামোগত দুর্বলতার সমালোচনা করে সকল দলের অংশগ্রহণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব।
|
|
বিএনপি ও পুরনো রাজনীতি
|
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিএনপিকে “পুরনো ধারার” রাজনীতি পরিহার করে জনগণকেন্দ্রিক রাজনীতি করার পরামর্শ দেন।
|
|
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
|
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়কে “পুরো পৃথিবীর জন্য নজির” হিসেবে আখ্যায়িত করে মন্তব্য করেন যে, এই রায় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা।
|
ঢাকা-৮ আসনে প্রার্থিতা ও অভিনব প্রচারণা
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে প্রার্থিতা ঘোষণা করে ওসমান হাদি জাতীয়ভাবে প্রশংসিত হন। তার নির্বাচনী প্রচারণা ছিল প্রচলিত ধারার রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত, যা তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা তৈরির একটি কার্যকর মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তার অভিনব পদ্ধতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
• এলাকাবাসীর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের জন্য “চা-সিঙ্গারা” আড্ডার আয়োজন।
• জনগণের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির ঘোষণা।
• ডোনেশনের মাধ্যমে নির্বাচনী তহবিল গঠন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার স্বচ্ছ হিসাব প্রকাশ, যার এক পর্যায়ে এক সমর্থকের পকেটে টাকা গুঁজে দেওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়।
• ভোরবেলা মসজিদের সামনে লিফলেট বিতরণ এবং কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মুড়ি-বাতাসা বিতরণের মতো জনসংযোগ, যা তাকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে।
ব্যক্তিগত জীবন ও বিতর্ক
তার রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও বিতর্কিত কিছু দিকও ছিল, যা তার চরিত্রকে আরও জটিল ও বহুমাত্রিক করে তোলে।
ব্যক্তিগত জীবন ও সৃষ্টিকর্ম
ব্যক্তিগত জীবনে ওসমান হাদি ছিলেন বিবাহিত এবং এক সন্তানের জনক। রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে তার একটি সৃজনশীল সত্তাও ছিল। তিনি সীমান্ত শরিফ ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন এবং ২০২৪ সালে তার ‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
বিতর্ক
ওসমান হাদি তার রাজনৈতিক জীবনে বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। ২০২৫ সালে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে সহিংসতার পর তিনি গোপালগঞ্জ জেলা ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তীব্র, গালিগালাজপূর্ণ মন্তব্য করেন, যা দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। প্রাথমিকভাবে তিনি তার এই ভাষাকে “মুক্তির মহাকাব্য” হিসেবে আখ্যায়িত করে নিজের অবস্থানের পক্ষে দাঁড়ালেও, পরবর্তীতে চাপের মুখে তার মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তার এই আপোষহীন ও প্রায়শই উত্তেজক রাজনৈতিক অবস্থান তাকে অনেকের লক্ষ্যে পরিণত করে, যা তার জীবনের করুণ পরিণতির প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
হামলা ও মৃত্যু
ওসমান হাদির বিপ্লবী জীবনের সমাপ্তি ঘটে এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। হামলার প্রায় এক মাস আগে থেকেই তিনি ফোনকল ও বার্তার মাধ্যমে হত্যার হুমকি পাচ্ছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। ২০২৫ সালের ১২ ডিসেম্বর, জুমার নামাজের পর ঢাকার বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হন। তার চোয়ালে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, যেখানে তিনি কোমায় চলে যান। অবস্থার অবনতি হলে ১৫ ডিসেম্বর তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যু-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ও তাৎপর্য
ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে।
• জনগণের প্রতিক্রিয়া: হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ঢাকার শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। জনরোষের তীব্রতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর এবং দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকার অফিসে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটে।
• সরকারি প্রতিক্রিয়া: উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান এবং হাদির মৃত্যুতে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন।
• রাজনৈতিক তাৎপর্য: এই হত্যাকাণ্ডকে অনেক রাজনৈতিক দল আসন্ন নির্বাচন বানচালের একটি গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করে। তার মৃত্যু প্রমাণ করে যে, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তখনও অত্যন্ত ভঙ্গুর ছিল।
ওসমান হাদির উত্তরাধিকার
ওসমান হাদির রাজনৈতিক জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত প্রভাবশালী। তার “চা-সিঙ্গারা” আড্ডার মাধ্যমে জনসংযোগ, স্বচ্ছ তহবিলের ব্যবহার এবং আধিপত্যবাদবিরোধী কঠোর অবস্থান প্রচলিত রাজনীতির অচলায়তন ভেঙে এক নতুন ধারার সূচনা করেছিল। তিনি ছিলেন একজন তরুণ বিপ্লবী, যিনি সাহস এবং উদ্ভাবনী কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। শিক্ষার্থীদের জন্য তার জীবন এই বার্তা রেখে যায় যে, প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে থেকেও সততা, উদ্ভাবনী কৌশল এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা দিয়ে রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। ওসমান হাদি শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও, তার আদর্শ ও স্বপ্ন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।



31Share