লক্ষ্মীপুর: বিশ বছর আগে নূরে আলমের বাড়ি ছিল মেঘনা নদী থেকে অন্তত ৫ কিলোমিটার দূরে। সে মেঘনা এখন তার বসত বাড়ির কিনারায়। কয়েক বছরে প্রায় দু’ একর ফসলি জমি খেয়েছে রক্ষুসী মেঘনা। তাতেও শান্ত থাকছেনা। এখন বসতঘর নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটায় ডুবিয়ে দিচ্ছে তাদের বসত-বাড়ি।মেঘনা নদী সংলগ্ন লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার জনতা বাজারের পাশে তার বাড়ির অবস্থান।
নূরে আলম বলেন, নদী কেন্দ্রীক আমার জীবিকা ছিল। মাছ ধরার ট্রলারের মাঝি ছিলাম আমি। এখন বয়স হয়েছে, তাই পেশা ছেড়ে দিয়েছি। ছেলেরা বিদেশে থাকে। তাদের নিয়ে হয়তো এ বসতিতে আর বেশিদিন থাকা যাবে না।
কৃষক ইউনুস মিয়ার (৪৫) বাড়ি মেঘনা নদী থেকে প্রায় দুইশ মিটার দূরত্বে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়নের দক্ষিণ চররমনী মোহন গ্রামে পূর্ব পুরুষের ভিটায় বসবাস তার। জন্ম থেকেই জেয়ার-ভাটা দেখে অভ্যস্ত। প্রতিদিন দুই বার নদীর জোয়ার-ভাটার খেলা দেখেন তিনি। তবে বর্ষা মৌসুমের অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ার কিংবা সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। যা গত তিন বছর থেকে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ সময়টাতে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষক ইউনুস মিয়ার বসতবাড়ি পানিতে নিমজ্জিত থাকে। ফলে স্বাভাবিক জীবনে বাঁধা সৃষ্টি হয়।
কথা হলে ইউনুস জানান, জোয়ারের পানি খুব সহজে তার ঘরে ঢুকে পড়ে। এছাড়া রান্নাঘরের চুলো, গোয়াল ঘর, উঠান, চলাচলের রাস্তা এবং ফসলি ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে যায়। এতে গবাদি গশু, হাঁস-মুরগিসহ বাড়ির শিশু সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়।
তিনি বলেন, ভাটাতেও নেই স্বস্তি। জোয়ারের পানির স্থায়িত্ব থাকে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। পানি নেমে যাওয়ার সময় ঘর ভিটার মাটি ধুয়ে নিয়ে যায়। ঘর স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে থাকে। চুলোয় পানি ঢুকে থাকায় রান্নার কাজ ব্যাহত হয়।
তিনি বলেন, পানি নামার পর নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। ক্ষেতের ফসলগুলোও নষ্ট করে দিয়ে যায়।
ইউনুসের মতো রুবেল, নাসির মাঝি, রইজুল মাঝি ও জাবের মাঝি তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে অতিরিক্ত জোয়ার-ভাটার সঙ্গে অনেকটা যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন। দুর্ভোগে কোনো জনপ্রতিনিধি তাদের খোঁজ নেয়নি বলে অভিযোগ তাদের।
গত পাঁচ-ছয়দিন থেকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিন্মচাপ এবং পূর্ণিমার প্রভাবে মেঘনা নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীর তীরবর্তী বাঁধ না থাকায় খুব সহজেই মেঘনার উপকূলে পানি ঢুকে পড়ে। জোয়ারের পানিতে লোকালয়, বসতবাড়ি, ফসলি ক্ষেত, পুকুর, খাল-বিল এবং রাস্তাঘাট ডুবে একাকার হয়ে গেছে। দুর্ভোগে পড়ে জেলার রামগতি, কমলনগর, রায়পুরের উত্তর চরবংশী ও দক্ষিণ চরবংশী এবং সদর উপজেলার চর রমনী মোহন ইউনিয়নের লক্ষাধিক বাসিন্দা।
গত কয়েকদিন থেকে কমলনগর ও সদর উপজেলার চররমনী মোহনের নদী তীরবর্তী এলাকা ঘুরে উপকূলীয় বাসিন্দারের করুণ চিত্র দেখা গেছে।
এছাড়া রামগতি উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর আবদুল্লাহ ইউনিয়নে বসবাসকৃত প্রায় ১৫ হাজার বাসিন্দা প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন।
ওই ইউনিয়নের বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন বলেন, এ দ্বীপেই জন্ম আমার। জন্মের পর থেকে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছি। দিনে দু’বার জোয়ার আসে। এতে আমরা পানিবন্দি হয়ে পড়ি। ভাটা পড়লে কিছুটা স্বস্তি মেলে। তবে জোয়ারের তোড়ে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
চররমনী মোহনের মেঘনা নদী সংলগ্ন বুড়িরঘাট এলাকার বাসিন্দা মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, তাদের এলাকায় নয় পরিবারে প্রায় অর্ধশতাধিক লোকের বসবাস। বাড়িতে নয়টি ঘর রয়েছে, জোয়ারে পানিতে সবগুলো ঘরের ভিটা তলিয়ে যায়। বৃদ্ধ এবং শিশুদের নিয়ে তারা দুর্ভোগের শিকার হন। এছাড়া গবাদি পশু এবং হাঁস-মুরগি পালনে বিপাকে পড়তে হয় তাদের। বাড়িতে যে পুকুর রয়েছে, তাতে মাছ চাষ করা বন্ধ রেখেছেন। কারণ জোয়ারের পানিতে পুকুর ভেসে মাছ বের হয়ে গেছে।
একই ইউনিয়নের চর আলী হাসান গ্রামের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, জোয়ারে প্রতিদিন ডুবি আর ভাসি। উপকূলে বসতি হওয়ায় যেন আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপকূলের বাসিন্দা কমলনগর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক সাজ্জাদুর রহমান জানান, মেঘনা উপকূল অরক্ষিত; রামগতির থেকে কমলনগর উপজেলার মতিরহাট পর্যন্ত প্রায় ৩৭ কি.মি. এলাকায় বেড়িবাঁধ নেই। অতিরিক্ত জোয়ারে লোকালয়ে খুব সহজে পানি ঢুকে। জোয়ারের সময় হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ভাটার সময় নদীর তীরে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দেয়। এদিকে, নামেমাত্র নদীর তীর রক্ষা বাঁধের কাজ শুরু করা হলেও এখন বন্ধ রয়েছে। দ্রুত বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় জনমনে ক্ষোভ রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতি বছর অমাবস্যা এবং পূর্ণিমার প্রভাবে মেঘনার অতিরিক্ত জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্লাবিত হয়েছে। দিনে দু’বার করে জোয়ার আসে।
চর লরেঞ্চ ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হোসেন আহম্মদ ও আব্দুল মান্নান বলেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময় লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে। জোয়ারের পানি যখন অতিমাত্রায় থাকে, তখন বিস্তীর্ণ এলাকাকে শুধু নদীই মনে হয়। জোয়ারের পানি নামার সময় রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
চর মার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইউসুফ আলী জানান, গত কয়েক বছরের মেঘনা নদীর সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে তার এলাকার রাস্তাঘাট, ফসলি জমি, মৎস্য খামারের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, “জোয়ারের কবলে পড়া দুর্গত বাসিন্দাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।”
রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম শান্তুনু চৌধুরী বলেন, “গত কয়েকদিনের জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের মাঝে শুকনো খবার দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।”
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফারুক আহম্মেদ বলেন, “রোববার (১৪ আগস্ট) জোয়ারের পানি প্রায় ৪ ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হয়েছে। এতে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। সোমবারও (১৫ আগস্ট) পানি উঠবে। এরপর থেকেই পানির মাত্রা কম থাকবে।”
লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনের সংসদ সদস্য মেজর (অঃ) আবদুল মান্নান রোববার (১৪ আগস্ট) একটি অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে বলেন, সরকার নদীর বাঁধ নির্মাণে ৩১শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এত বড় একটি কাজতো একদিনে, একমাসে বা এক বছরে হবে না। কিন্তু বরাদ্দ যেহেতু দিয়েছে, কাজ অবশ্যই হব। সবাইকে ধৈর্য্য ধরতে হবে।
0Share