প্রকাশিত সংবাদের কারণে রাঙামাটির দুইটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদকের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করাকে ‘গণমাধ্যমের কন্ঠরোধের চেষ্টা’ এবং ‘ স্বাধীন সাংবাকিতায় নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে দাবি করেছেন রাঙামাটির বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রবীন সাংবাদিক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি সুনীল কান্তি দে বলেছেন, সংবাদ প্রকাশে কেউ ক্ষুব্ধ হলে তাঁর উচিত প্রতিবাদলিপি দেয়া, কিন্তু তা না করে যদি সরাসরি মামলায় কেউ যান, তাহলে সেটি অত্যন্ত দু:খজনক।’
রাঙামাটি রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি ও দৈনিক যুগান্তর প্রতিনিধি সুশীল প্রসাদ চাকমা বলেন, এভাবে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের উপর মামলার চেষ্টা, মত প্রকাশ এবং সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে খর্ব করে। এমন মামলা দায়ের করার চেষ্টা খুবই নিন্দনীয়।’
খেলাঘর রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি জাহেদ আবেদীন বলেছেন, আমরা মনে করি সমাজের সকল অসঙ্গতি ও সত্য প্রকাশ করবে সাংবাদিকরা। সাংবাদিকদের এমন মত প্রকাশ মামলা দিয়ে রোধ করা অনুচিত কাজ।
অনলাইন নিউজপোর্টাল সিএইচটি টুডে’র সম্পাদক ফজলুর রহমান রাজন বলেন, এমন মামলার চেষ্টা খুবই নিন্দনীয়। জেলা প্রশাসকের সাথে রেস্টুরেন্টের চুক্তি যার সাথে হয়েছে তার নাম আবুল হোসেন, তাহলে অন্য কেউ কেন মামলা করতে যাবে ? সাংবাদিক উভয় পক্ষের কথা শুনে, যা সত্য তা লিখেছে, তার জন্য এমন মামলার চেষ্টা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এটি গণমাধ্যমের কন্ঠ রোধ করার অপচেষ্টা।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি রাঙামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অনুপম বড়ুয়া শংকর বলেন, ক্ষমতার দাম্ভিকতায় অন্ধ হয়ে এরা ভাবে, তাদের যা মন চায় তারা সবকিছু করতে পারবে। সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে এমন মামলার চেষ্টার নিন্দা জানানোরও অযোগ্য। ক্ষমতা ও প্রভাব দেখিয়ে এরা সবকিছু কুক্ষিগত ও সাংবাদিকদের ভয় দেখিয়ে কৃতদাস বানানোর চেষ্টা করছে।’
রাঙামাটি পৌর নাগরিক অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব এম জিসান বখতেয়ার বলেন, প্রকাশিত সংবাদ সবার পক্ষে যাবে তেমনটি ভাবার কোন কারন নাই। তবে কেউ যদি মনে করেন কোন সংবাদ তার জন্য অপমানজনক বা সত্য নয়, তাহলে সেটির জন্য প্রতিবাদলিপি দিতে পারতো, কিন্তু তা না করে সরাসরি মামলার চেষ্টা করা খুবই দু:খজনক। এটি ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি খারাপ নজির ।’
রাঙামাটি জেলা রেডক্রিসেন্ট ইউনিটের সাবেক সেক্রেটারি আবু সাদাৎ মো: সায়েম বলেন, ক্ষমতার মোহে এরা কোন ধরনের সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। তাই সাংবাদিকদের কন্ঠ রোধ করে অনুগত বাহিনীতে পরিণত করার জন্য এমন মামলার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
রাঙামাটি জেলা যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মিল্টন বিশ্বাস বলেন, দেশব্যাপী গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে দমন নিপিড়নের যে নগ্ন চিত্র দেখা যায়, তার সামান্য প্রতিফলন মাত্র এমন মামলা দায়ের চেষ্টা। এমন চেষ্টায় ঘৃনা প্রকাশ করছি।’
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন রাঙামাটি জেলার সভাপতি অভিজিৎ বড়ুয়া বলেন, ক্ষমতা বা পেশীশক্তি চর্চার কারণেই মুলত তারা কোন ধরনের সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। তাই কোন সংবাদ তাদের পছন্দ না হলেই মামলা হামলা করার চেষ্টা করে। এটি জঘন্য একটি কাজ।’
রাঙামাটি রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির সহ সভাপতি ও রাঙামাটি কলেজের সাবেক জিএস জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বলেন, রেস্টুরেন্ট ভাড়াদাতা ও ভাড়াগ্রহিতার বিরোধ থাকতেই পারে, সাংবাদিকরা সত্যটাই তুলে ধরেছেন, সে বিষয়ে কোন বক্তব্য থাকলে সেটিও দিতে পারতেন সাবেক এমপি। কিন্তু এভাবে একজন সাবেক সংসদ সদস্যের সরাসরি মামলায় যাওয়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
রাঙামাটি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আল হক বলেন, এলাকায় কোন ঘটনা ঘটলে তা তুলে ধরা সাংবাদিকের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে সাংবাদিকরা ভুল তথ্য দিয়ে থাকলে, তা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রতিবাদলিপি দেয়া যেতে পারে। ভুল তথ্য দিলে মামলা বা নিবর্তনমূলক কোন কর্মকান্ড গ্রহণ করা উচিত নয়। এমন কর্মকান্ড গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ করার সামিল।’
রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এস এম শামসুল আলম বলেন, মামলা করার চেষ্টা অত্যন্ত নিন্দনীয়। রেস্টুরেন্ট নিয়ে বিরোধ, সেটি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনও হয়েছে, সাংবাদিকের দায়িত্ব নিউজ করা, সেটি নিজের গায়ে নিয়ে সাংবাদিকদের হেনস্তা করা অন্যায়। এমন কর্মকান্ডের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হচ্ছে বলে প্রতিয়মান হয়।’
প্রসঙ্গত,রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের ‘ডিসি বাংলো পার্ক’ তিন বছর আগে মোঃ হোসেন নামে এক ব্যক্তি ব্যবহার করার অনুমতি নেন,নির্দিষ্ট ১৩ টি শর্তে,২ বছরের জন্য। পরে সেখানে ‘পাইরেটস’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট চালু করেন এক নারী,যিনি নিজেকে মোঃ হোসেন এর ‘ব্যবসায়িক অংশীদার’ দাবি করছেন।
মেয়াদান্তে জেলা প্রশাসন ‘ব্যবহারের অনুমতি’ নবায়ন করতে অপারগতা জানালে জেলা প্রশাসনের সাথে বিরোধ তৈরি হয় সেই রেস্টুরেন্ট এর মালিক সেই নারী নাজনীন আনোয়ারের,যিনি রাঙামাটির সাবেক সংরক্ষিত সংসদ সদস্য ও জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ফিরোজা বেগম চিনুর জৈষ্ঠ্য কণ্যা।
বিরোধের জেরে জেলা প্রশাসক ও তার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে চারটি মামলা দায়ের করেন তারা এবং সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। এ বিরোধ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় তিন পার্বত্য জেলার সর্বাধিক পঠিত অনলাইন পোর্টাল পাহাড়টোয়েন্টিফোর ডট কম সম্পাদক ফজলে এলাহী এবং ‘আলোকিত রাঙামাটি’ নামের আরেকটি অনলাইনের বিরুদ্ধে ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর পৃথক দুটি সাধারন ডায়রি করেন ফিরোজা বেগম চিনু ও তার কণ্যা নাজনীন আনোয়ার। ১৪ ডিসেম্বর কোতয়ালি থানা পুলিশ অভিযোগ দুটি তদন্তের অনুমতি চাইলে ৩০ ডিসেম্বর সেই অনুমতি প্রদান করেন রাঙামাটির চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
0Share