লক্ষ্মীপুর জেলার তৃণমূল সাংবাদিকতায় অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রবীণ ও গুণী সাংবাদিক ক্যাটাগরিতে ‘বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ২০২১’ পেয়েছেন লক্ষ্মীপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি হোসাইন আহমেদ হেলাল। তিনি লক্ষ্মীপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক নতুন চাঁদ পত্রিকার সম্পাদক। সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) এক জমকালো অনুষ্ঠানে তাদের হাতে সম্মাননাপত্র তুলে দেয়া দেওয়া হয়।
সরকারের তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ২০২১ এর জুরিবোর্ডের প্রধান অধ্যাপক ড. গোলাম রহমানসহ অনুষ্ঠানের অতিথিরা এই অ্যাওয়ার্ড হস্তান্তর করেন। অ্যাওয়ার্ডের মধ্যে রয়েছে- নগদ টাকার চেক, ক্রেস্ট, সনদপত্র এবং উত্তরীয়।। দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের উদ্যোগে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় অ্যাওয়ার্ড প্রদান উপলক্ষে গুণী সাংবাদিকদের এই সম্মাননা দেয়া হয়।
সাংবাদিক হোসাইন আহমেদ হেলাল ১৯৮১ সাল থেকে লেখালেখি করেন তখনকার স্থানীয় পত্রিকা সাপ্তাহিক নতুন সমাজ ও সাময়িক বার্তায়। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর যোগ দেন জাতীয় দৈনিক দেশ পত্রিকায়। পড়াশুনার পাশাপাশি সংবাদ সংগ্রহ ও সংবাদ তৈরির কাজ চলতো নিয়মিত। ১৯৮৮ সালে সানা উল্লাহ নূরী সম্পাদিত দৈনিক জনতা’র জেলা প্রতিনিধি হিসেবে। পরে একই পত্রিকার পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯১ সালে লক্ষ্মীপুরে প্রকাশ করেন লক্ষ্মীপুরের সাপ্তাহিক নতুন পথ। এরই মধ্যে তিনি দৈনিক ইনকিলাব এর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর ১৯৯৫ সালে কাজ শুরু করেন দৈনিক জনকণ্ঠে।
উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের দুর্গম চরাঞ্চল নিয়ে শুরু হয় তার বিশ্লেষণধর্মী লেখালেখি। চর গজারিয়া, বয়ার চর, তেলির চর নিয়ে তার লিখা সিরিজ আকারে প্রকাশ করে দৈনিক জনকণ্ঠ। ‘চরের মানুষ, চরের জীবন’ শিরোনামের এই সিরিজ ব্যপক আলোচনায় আসে। এর একটি সংবাদের প্রাতিবাদ আসলে তা ছাপা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় দৈনিক জনকণ্ঠের কর্তৃপক্ষের সাথে। ১৯৯৯ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ ছেড়ে আবারো যোগদান করেন দৈনিক ইনকিলাবে।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে অনেক ঝড় ঝাপ্টা সামলাতে হয়েছিলো হোসাইন আহমদ হেলালকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বয়ার চর, চর গজারিয়ার লাঠিয়াল বাহিনী এবং লক্ষ্মীপুর-ভোলা সীমানা বিরোধ নিয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহ করতে হত নিয়োমিত। পরিচয় গোপন রেখে কিংবা ছদ্মবেশ ধারণ করে সংবাদ সংগ্রহ করতেন তিনি। অধিকাংশ সময়ই সহকর্মী কাউছারকে নিয়ে নিজেদের স্বাস্থ্যকর্মী পরিচয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতেন তিনি। তার লেখালেখির কারণে ওইসব অঞ্চল এখন দখল মুক্ত। নিরাপদ জনপদ হিসেবে শান্তিতে বসবাস করছে ওখানকার মানুষ।
১৯৯৮ সালে ‘লক্ষ্মীপুর সন্ত্রাসের জনপদ’ শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠের প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে কারাবরণ করতে হয়েছিলো হোসাইন আহমদ হেলালকে। এছাড়াও একটি রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজির মামলায় ১৭ দিন নোয়াখালীতে কারাবন্ধী ছিলেন। প্রায় ৩ বছর আত্মগোপনে থেকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে লেখালেখি চালিয়েছেন। পার্শবর্তী জেলা নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনীতে থেকেও থেমে থাকেননি তিনি। এই ৩ বছরে রাজনৈতিক নেতারা ১৭টি মামলা রজু করে তার বিরুদ্ধে। সরকার পরিবর্তন হলে রামগঞ্জে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে অওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’বছর সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলো। এনিয়ে নিয়মিত লেখালিখি করতে গিয়ে তখনকার এক প্রতিমন্ত্রীর নানান হুমকি ধমকিও শুনতে হয়েছিলো। প্রতিমন্ত্রীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হোসাইন আহমদ হেলালের লেখনী অব্যাহত ছিলো। এনিয়ে আরো দুইটি মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলায় জড়ানো হয় তাকে। ১/১১ এর সময়কার সেনাবাহিনী সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদ ছাপানোকে কেন্দ্রকরে বিশেষ ধারায় মামলা করে কারাগারে পাঠায়। ৬ মাস ১৪ দিন কারাবরণের পর হাইকোটের নির্দেশে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
২০০৫ সালে লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে সম্পাদনা শুরু করেন ‘দৈনিক নতুনচাঁদ’ এর। তার প্রকাশনায় এখনও দৈনিক নতুনচাঁদ ও সাপ্তাহিক নতুনপথ প্রকাশিত হচ্ছে। সাহসী ও বস্তুনিষ্ঠ লেখনীর কারণে ২০০৮ সালে দৈনিক ইনকিলাব হোসাইন আহমদ হেলালকে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে পদোন্নতি দেয়। এছাড়াও তিনি বাংলাভিশন, একুশে টিভি, এশিয়ান টিভি, দৈনিক মুক্তকণ্ঠ, দৈনিক দিনকালে কাজ করেছেন। ২০১২ সালে দৈনিক ইনকিলাব এর সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার পদন্নোতি দিয়ে ঢাকা অফিসে নিয়ে যায় দৈনিক ইনকিলাব কর্তৃপক্ষ। ২০১৭ সালে বিশেষ সংবাদদাতায় পদন্নোতি পান তিনি।
২০১৯ সাল পর্যন্ত ঢাকায় কাজ করেছেন তিনি। এরপর তিনি ফিরে আসেন নিজ জেলা লক্ষ্মীপুরে। বর্তমানে তিনি লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে দৈনিক নতুনচাঁদ পত্রিকার সম্পাদনা করছেন।
লক্ষ্মীপুর জেলার সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করার সুবাদে মিডিয়া সংক্রান্ত এনজিও ম্যাসলাইন মিডিয়া সেন্টার এর লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি নিযুক্ত হন ১৯৯৮ সালে। এনজিও এর মাধ্যমে তিনি লক্ষ্মীপুর জেলায় বিভিন্ন কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে প্রায় শতাধিক প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করেছেন। এ জেলার সংবাদকর্মী এবং স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকদের নিয়ে ৫০টি প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করেছেন।
লক্ষ্মীপুর প্রেসকাবের পাঁচ বারের নির্বাচিত সভাপতি ও তিন বারের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছিলেন হোসাইন আহমদ হেলাল। বর্তমানেও তিনি লক্ষ্মীপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী ‘বসুন্ধরা’ এ প্রথম যারা জাতীয় ও তৃণমূল সাংবাদিকতায় পুরো দেশ নিয়ে ভেবেছে। স্বীকৃতি দিয়েছে আত্মনিবেদিত সংবাদ কর্মীদের। প্রান্তিক জনপদের সংবাদের একজন কর্মী হিসবে এমন স্বীকৃতি, সম্মাননা প্রদান করেছেন লক্ষ্মীপুর জেলার অদম্য সাহসী প্রবীণ সাংবাদিক হোসাইন আহমদ হেলালকে।
জম্ম:
১৯৬৪ সালের ২১ জুন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর টুমচর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জম্ম গ্রহণ করেন হোসাইন আহমদ হেলাল। তার পিতা ডা. আহসান উল্লাহ ও মা অহীদা খাতুন। সাত ভাই বোনের মধ্যে চার নাম্বার তিনি।
শিক্ষা জীবন:
১৯৮১ সালে লক্ষ্মীপুর মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৮৪ সালে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ১৯৮৮ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।
0Share