বিশেষ প্রতিবেদন,লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর: সন্ত্রাসের জনপদ বা ডেঞ্জারজোন বলে খ্যাত লক্ষ্মীপুরে রক্তাক্ত মৃত্যু আর অপরাধ যেন থামছেই না।আধিপত্য বিস্তার, চাঁদবাজি, চাঁদার টাকা ভাগবাটোয়ারা ও মাদক ব্যবসার বিরোধের জের ধরে জেলার বশিকপুর, চন্দ্রগঞ্জ, জয়পুর, মিরিকপুর, দেওপাড়া, দত্তপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়তই লাশ পড়ছে। নিয়মিত হত্যাকান্ড ছাড়াও ধর্ষণ, আত্মহত্যা, অপহরণ, বন্দুকযুদ্ধ, ডাকাতি, হামলা এবং প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য চাঁদাবাজি ও হচ্ছে যখন তখন।
এ নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতারা উদ্বিগ্ন। তাদের মতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, পারিবারিক কলহ, জমি সংক্রান্ত বিরোধ, ডাকাতি ও সন্ত্রাসী বাহিনীর আধিপত্য বিস্তার, দলীয় কোন্দলের পরিণামে খুনসহ এসব অপরাধ ঘটছে। পুলিশ ও স্থানীয় তথ্য এবং লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোরে প্রকাশিত সংবাদের তথ্যমতে, গত কয়েক মাসে জেলার বিভিন্ন স্থানে ২৫টি লাশের খবর, বেশ কয়েকটি আলোচিত ধর্ষণ ও ডাকাতির খবর প্রকাশিত হয়েছে।
লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোরের অপরাধ বিভাগে প্রতিদিনই এ সংক্রান্ত কোন না কোন সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এ সকল অপরাধের মধ্যে জেলা ব্যাপী হত্যাকান্ডের ঘটনা গুলোই সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে জেলাব্যাপী খুনের ঘটনা বিশেষ করে হত্যা, ঝুলন্ত লাশ আর উদ্ধার হওয়া লাশের ওপর লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত সংবাদের সংকলন নিয়ে আমাদের এবারের বিশেষ প্রতিবেদন।
২ জানুয়ারি থেকে ২৫ মে পর্যন্ত জেলা ব্যাপী খুনের যত ঘটনা:
২৫ মে: বেলা ১১ টায় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয় প্রকাশ্যে দিবালোকে মো. ইসমাইল হোসেন চৌধুরী (৫০) ও ইব্রাহীম হোসেন রতন (৪৫) নামের ২ ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। লক্ষ্মীপুরের বশিকপুর এলাকার বৌদ্ধের বাড়ির মোড়ে চা দোকানে তাদের কে হত্যা করা হয়। দুই ভাইয়ের মধ্যে ইব্রাহীম হোসেন রতন এলাকায় সন্ত্র্রাসী কর্মকান্ড করতো বলে পুলিশ জানায়।
১১ মে: বশিকপুর এলাকায় লাদেন মাসুম বাহিনীর সদস্য ইউসুফ গুলিতে নিহত হয়েছেন। পুলিশের দাবি বন্দুকযুদ্ধে তার মৃত্যু হয়েছে।
৯মে: লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থানাধীন চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের বিস্মিল্লাহ রোড এলাকায় বেকারীর এক কিশোর শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিহতের নাম মোঃ আলাউদ্দিন (১৩)।
৩০ এপ্রিল: লক্ষ্মীপুর পৌরসভার সমসেরাবাদ গ্রামে জান্নাতুল ফেরদৌস (২৫) নামের এক প্রবাসীর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
৩০ এপ্রিল: আরবি পড়তে গিয়ে চতুর্থ শ্রেণির এক শিশুছাত্রী মক্তবের শিক্ষক কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে চন্দ্রগঞ্জ থানাধীন হাজিরপাড়া ইউনিয়নের হরিহর চক্র গ্রামে।
২৮ এপ্রিল: রাজিবপুরে মধ্য রাতে বাড়ি থেকে মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে ইসমাইল হোসেন মানিক ও কামরুল ইসলাম নামের দুই আওয়ামী লীগ কর্মীকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে ১০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। নিহত মানিকের ভাই মোরশেদ আলম বাদী হয়ে সদর থানায় এ মামলা করেন।
২৭ এপ্রিল: রায়পুরের উপজেলার দক্ষিণ কেরোয়া গ্রামে ২৭ এপ্রিল সকালে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় মো. আরিফ হোসেন নামে এক নৈশপ্রহরী নিহত হন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত মিথুনকে আটক করা হয়।
২৫ এপ্রিল: রায়পুরের চরপাতা গ্রামে ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার।
২০ এপ্রিল: কমলনগরে ওই স্কুল ছাত্রীকে কৌশলে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে ধর্ষণ।
১০ এপ্রিল: রায়পুরে ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে আড়াই লাখ টাকা লুট।
১৮ এপ্রিল: কমলনগরে ফলকনকাচিয়ার খাল মাছঘাট এলাকা থেকে মাছ ধরার ট্রলার থেকে কবির হোসেন নামে এক জেলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কিন্তু কোনো তথ্য উদঘাটন করতে পারেননি।
৭ এপ্রিল: পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কাউছার হোসেন ওরফে বড় কাউছার নিহত হয়েছে। বৃহস্পতিবার( ৭ এপ্রিল) ভোররাতে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম লতিফপুর গ্রামের ৩ নম্বর পোল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
৬ এপ্রিল : জেলার কমলনগরের চর লরেন্সে ডাকাতের গুলিতে আবদুল ওয়াদুদ জমাদ্দার নামে এক গৃহকর্তা নিহত হন। এ সময় ডাকাতদের হামলায় দুজন গুলিবিদ্ধসহ দুই পরিবারের চারজন আহত হন। এ দিকে জেলার বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১০টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় একাধিক নারী ধর্ষণের ঘটনার শিকার হয়েছেন বলে সূত্রে জানা যায়। সম্প্রতি সদর উপজেলার চররুহিতা ইউনিয়নের নবীগঞ্জ ও বেড়ির পাশে ডাকাতিকালে ধর্ষণের শিকার হন একাধিক নারী। কিন্তু সামাজিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে ভুক্তভোগীরা মুখ খুলছেন না বলে একাধিক গ্রামবাসী জানান।
৫ এপ্রিল: সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম চর উভূতি গ্রামে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলা ও দুই সহোদর বোনকে নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে।
৩ এপ্রিল: দিনগত রাতে চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর গ্রামে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে অস্ত্র ও ডাকাতিসহ মোট ছয় মামলার আসামি আবু কাউসার নিহত হন। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে একটি এলজি ও ৪ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। এ বন্দুকযুদ্ধে পুলিশের একজন উপপরিদর্শকসহ দুই কনস্টেবলও আহত হন বলে জানায় পুলিশ।
২৯ মার্চ: রাতে তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের ইসলামগঞ্জ বাজারের পাশে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে দুই বোন গণধর্ষণের শিকার হন।
১২ মার্চ: কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা গ্রামের চক বাজার এলাকায় জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে আল মাসুদ লিমন (৫০) নামের একজন নিহত হয়েছেন।
১ মার্চ: লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার টুমচর গ্রামে হামলার শিকার হয়ে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। জমি সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের লোকজন এ হামলা চালায়।
২০ ফেব্রুয়ারি: রায়পুরে অজ্ঞাত (৩২) নামের এক যুবকের গালাকাটা মাথা বিহীন লাশ উদ্ধার করেছেন থানা পুলিশ।
১৩ ফেব্রুয়ারি: কমলনগরে পৃথক ঘটনায় সাজু বেগম (২৪) নামের এক নারীর অর্ধঝুলন্ত মৃতদেহ এবং আবদুল গণি (৩৮) নামে এক যুবকের ঝুলন্ত মৃতহেদ উদ্ধার করা হয়েছে।
৮ ফেব্রুয়ারি: রামগঞ্জে পুলিশের ধাওয়ার ৫দিন পর রাসেল (২৫) নামের এক যুবলীগ কর্মীর লাশের সন্ধান
২৩ জানুয়ারি: রায়পুরে এক অজ্ঞাত নারীর (৪০) রক্তাক্ত ও জখম হওয়া লাশ উদ্ধার।
১৬ জানুয়ারি: কমলনগরে যুবতীর লাশ উদ্ধার।
১১ জানুয়ারি: লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের দক্ষিণ মান্দারী এলাকা থেকে জাহেদা বেগম ও বিজয়নগর থেকে আসমা বেগম নামে দুই গৃহবধূর লাশ উদ্ধার
৭ জানুয়ারি: রামগঞ্জে প্রবাসীর বাড়িতে চুরি করতে এসে গণপিটুনিতে এক চোরের মৃত্যু।
৬ জানুয়ারি: রায়পুরে হাত-পা বাধা অবস্থায় ধান ক্ষেত থেকে জলিল সরদার (৩০) নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার।
২ জানুয়ারি: কমলনগরে স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ করে ভিডিও প্রকাশের দায়ে ৪ জন গ্রেফতার।
কেন এ সব হত্যাকান্ড বা লাশ ?
এ উত্তর খুঁজতে গেলে সংবাদ মাধ্যকে স্থানীয়রা জানান, সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত জেলায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত রাজনৈতিক ক্যাডাররা প্রায় সময় বন্দুকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্ত্রবাজরাও মাঠ দখল করে আছেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সন্ত্রাস, দখল, অস্ত্রবাজি, খুন-খারাবিতে পিছিয়ে নেই ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররাও।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) জেলা কমিটির সদস্য গাজী গিয়াস উদ্দিন বলেন, মাদক এখন অনিয়ন্ত্রিত ও ব্যাপক। এ কারণে খুন, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানিসহ অন্যান্য অপরাধ বাড়ছে, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে এসব অপরাধকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করার আহ্বান জানান তিনি।
ভুক্তভোগী স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য চাদাঁবাজি, অপহরণ এবং ডাকাতি যেন এখন নিয়মিত ঘটনা। বিভিন্ন নামে গজিয়ে ওঠা সন্ত্রাসী বাহিনী কোন না কোন রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ হয়েই দাবিয়ে বেড়াচ্ছে।প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের আক্রমণ এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজ দলের গ্রুপিংয়ের কারণেও এসব খুনোখুনির ঘটনা ঘটে।সবমিলে সন্ত্রাসীদের আগ্রাসী মনোভাব ও একের পর এক হত্যা, গুমসহ নানা কর্মকান্ডে জেলাবাসী অতিষ্ঠ।
এদিকে লক্ষ্মীপুরের পুলিশের পক্ষ থেকে সংবাদ মাধ্যমে কে জানানো হয় যে, জানান, বিগত সময়ে বেশ কয়েকটি যৌথ অভিযানে পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন মামলার প্রায় ৫ শতাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ অঞ্চলের মানুষ যাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারে সেদিকে পুলিশের বিশেষ নজর রয়েছে।জেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তদন্ত চলছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
আরো পড়ুন——-
ডেঞ্জারজোন লক্ষ্মীপুর ! ২৩ মাসে ২৪ লাশের খবর
লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোরের অপরাধ বিষয়ক সংবাদ লিংক:
লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোরে মৃত্যুর সংবাদ বিষয়ক লিংক:
0Share