হাসান মাহমুদ শাকিল: লক্ষ্মীপুর জেলায় ৫টি উপজেলায় প্রায় ১৮ লাখ মানুষ বসবাস করে। এ জেলার অধিকাংশ মানুষ হতদরিদ্র। প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে কিংবা জেলার বাইরে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা সেবা নেয়া এদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠির চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য ১০০ শয্যা বিশিষ্ট লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই এ হাসপাতালে রোগীদের ভীড় দেখা যায়। হাসপাতালটি ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হলেও এতে প্রায় ২’শ থেকে ২৫০ জন রোগী সব সময় ভর্তি থাকেন এবং ১ হাজার থেকে ১৫’শ রোগী প্রতিদিনই চিকিৎসা সেবার জন্য ভীড় জমাতে দেখা যায়। অতিরিক্ত রোগীদের প্রতিনিয়তই হাসপাতালের মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা দিতে দেখা যায়। হাসপাতালটি ১০০ শয্যা হওয়ায় অতিরিক্ত ভর্তি থাকা রোগীরা খাবার থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক রোগীর বাড়ি দূরে হওয়ায় পাশ্ববর্তী হোটেল থেকে খাবার কিনে খেতে হয়। এসব হোটেলে অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করতে দেখা যায়। এতে রোগীরা স্বাস্থ্যকর খাবার থেকে বঞ্চিত হয় বলে জানা যায়।
হাসপাতালে ভর্তি কয়েকজন রোগী জানান, সদর হাসপাতালের ভর্তি রোগীদের মোটামুটি ভালোই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ রোগী হাসপাতালের মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা নিতে হয়। এমনকি অধিকাংশ রোগী হাসপাতাল থেকে কোন খাবার পায় না। তাই তাদের ধারণা শয্যা বাড়ানো এবং সকল রোগীদের জন্য খাবার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হাসপাতালের ভর্তি রোগীরা সঠিকভাবে চিকিৎসা সেবা নিতে পারবে। তাই উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে শয্যা বাড়নো ও সকল রোগীর খাবার নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানান তারা।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা কয়েকজন রোগী জানান, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাদের চিকিৎসা সেবা ভালো হয় বলে এখানে আসা হয়। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের আশ-পাশ ও ভেতরে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব রয়েছে। তাই অধিকাংশ রোগী ডাক্তার দেখাতে আসলেও এ হাসপাতালে ভর্তির কথা চিন্তাও করেন না। হাসপাতালটি প্রতিনিয়ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হলে রোগীরা স্বস্তি পাবেন বলে তাদের ধারণা।
হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের জনগোষ্ঠির চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য ১৯৭৩ সালে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল স্থাপিত হয়। ১৯৮৬ সালে এর শয্যা ৫০-এ বাড়ানো হয়। শয্যা কম হওয়ায় জেলার অধিকাংশ মানুষকে চিকিৎসা সেবা সঠিকভাবে প্রদান করা সম্ভব না হওয়ায় ২০০৩ সালে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নিত করা হয়। তবে হাসপাতালটির ১০০ শয্যায় উন্নিত হলেও ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারী বাড়ানো হয় নি। ৫০ শয্যার ডাক্তার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী দিয়েই চিকিৎসা সেবা চলছে। ১০০ শয্যায় উন্নীত’র ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও হাসপাতালটি চলছে ৫০ শয্যার লোকবল দিয়ে। এতে রোগীদের সঠিক সময়ে চিকিৎসা সেবা দেয়া যাচ্ছে না বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে ১৫০ জন কর্মচারী-কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও কর্মরত রয়েছেন ৭১ জন। এ ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ৭৯ টি পদই শূন্য রয়েছে। এখানে ১ম শ্রেণির ডাক্তার ৪২ জনের পরিবর্তে কর্মরত রয়েছেন ১৪জন। এতে ২৮টি পদই শূন্য রয়েছে। ৪০ জন নার্সের পরিবর্তে কর্মরত রয়েছেন ২৭জন। এতে শূন্য পদ রয়েছে ১৩টি। ৩য় শ্রেণির বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ২৬জনের পদ থাকলেও কর্মরত রয়েছেন ১৫ জন। বাকি ১১টি পদই শূন্য রয়েছে। এ হাসপাতালে ১৫০ টি পদের ৭৯টিই শূন্য থাকায় অলসভাবে চলছে চিকিৎসা সেবা। প্রতিদিনই দেখা যায় অসংখ্য রোগী হাসপাতালে এসে চিকিৎসা না নিয়েই চলে যেতে হয়। এভাবে প্রতিনিয়ত অসংখ্য রোগী সঠিক ভাবে চিকিৎসা সেবা নিতে পারছেন না বলে জানা যায় সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।
এদিকে হাসপাতালের অধিকাংশ পদ শূন্য থাকায় অতিরিক্ত সময় দায়িত্ব পালন করতে হয় ডাক্তার, নার্সসহ অন্যান্যদের। এতে সঠিক সময়ে চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। এভাবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা সেবা নিতে না পারায় রোগীদের দূর্ভোগ পোহাতে হয়। যা অনেক সময় অতিরিক্ত অসুস্থ্যতা ও মৃর্ত্যুর কারণও হয়ে থাকে। এতে রোগীর পরিবারকে ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়। হাসপাতালে শয্যা অতিরিক্ত রোগী ভর্তি হওয়ায় রোগীদের মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো হয়। এতে হাসপাতালে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং রোগীদের সঠিকভাবে চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে, হাসপাতালটি ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হলেও এতে প্রায় ২’শ থেকে ২৫০ জন রোগী সব সময় ভর্তি থাকেন। তাই অতিরিক্ত ভর্তি থাকা রোগীরা খাবার পান না। তারা হাসপাতালের খাবার থেকে বঞ্চিত হন। দেখা যায়- অনেক রোগীর বাড়ি দূরে হওয়ায় পাশ্ববর্তী হোটেল থেকে খাবার কিনে খেতে হয়। এসব হোটেলে অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করতে দেখা যায়। এতে রোগীরা স্বাস্থ্যকর খাবার থেকে বঞ্চিত হয়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ায় আরো বেশি অসুস্থ্য হয়ে পড়ে বলে জানা যায়।
হাসপাতালের পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে দেখা যায়, আসনের চেয়ে দিগুন রোগী ভর্তি রয়েছে। তাই অনেককেই হাসপাতালের মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এরা কোন রকম ওষুধ পেলেও খাবার থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে তাদের। খাবার না পাওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুর্নীতির করছেন বলে রোগীদের ধারণা বলে জানা যায়।
সম্প্রতি সদর উপজেলার পার্বতীনগর গ্রামের থেকে আসা মেডিসিন বিভাগের রোগী সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমার বুকের ব্যাথার কারনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বেড খালী না থাকায় মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা নিচ্ছি। মাঝে মাঝে কিছু ওষুধ দিলে বেশিরভাগ ওষুধ ফার্মেসী থেকে কিনতে হয়। খাবারের কথা জানতে চাইলে তিনি জানান, ৪দিন হল তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একদিনও হাসপাতাল থেকে তিনি খাবার পান নি। বাড়ি থেকে খাবার আনতে সমস্যা হয়। তাই বাইরের হোটেল থেকে প্রতিদিন খাবার কিনে এনে খেতে হয়েছে।
হাসপাতলের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর সমসেরাবাদ এলাকা থেকে আসা ডাইরিয়া রোগী সালমার মা জানান, তাঁর মেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় ২ দিন হল তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে ক্লিনার কম থাকায় সকালে একবার কোন রকম ওয়ার্ড পরিস্কার করতে দেখা যায়। বেডের অসুস্থ্য বাচ্চাদের খাওয়ানোর সময় মেঝেতে ময়লা-আবর্জনা পড়লে সারাদিনেও আর পরিস্কার করা হয় না। এতে ওয়ার্ডে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
রোগীদের সেবা দেয়ার কথা জানতে চাইলে সদর হাসপাতালের কর্মরত নার্স কুসুম আক্তার জানান, শয্যার তুলনায় অতিরিক্ত রোগী ভর্তি এবং অধিকাংশ পদ শূন্য থাকায় প্রতিনিয়ত রোগীদের সেবা করতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। এসময় খাবার সংকটসহ পরিষ্কার পরিচ্ছনতার অভাবের কথা স্বীকার করেন তিনি।
শূন্যপদে লোক নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ গোলাম ফারুক ভূঁইয়া জানান, সদর হাসপাতালে ১৫০টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে ৭৯টি পদই শূন্য রয়েছে। হাসপাতালের শূন্যপদগুলো পূরণের জন্য নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের বিষয় স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় ও মহা পরিচালকের কার্যালয়ে ২৫ বার আবেদনপত্র প্রেরণ করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত কোন চিঠি পাননি তিনি।
খাবার পরিবেশন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, হাসপাতালে শয্যার তুলনায় অতিরিক্ত রোগী ভর্তি থাকেন। তাই এদের বেড এবং খাবার ঠিকমতো দেয়া সম্ভব হয় না। এতে অনেক রোগী খাবার থেকে বঞ্চিত হন। তাই শয্যা বিবেচনা না করে ভর্তির তালিকা অনুযায়ী সব রোগীদের খাবার দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিকট জোর দাবি জানিয়েছেন লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন।
0Share