লক্ষ্মীপুর:: রফিকুল ইসলাম মন্টু। বর্তমান সময়ে উপকূল সাংবাদিক এক কিংবদন্তি। যার চিন্তা-চেতনা উপকূলকে ঘিরে। শুধু শীত-গ্রীস্ম-বর্ষা নয়, সারাবছরই তিনি খবরের খোঁজে ছুটে চলেন উপকূলর পথে পথে। প্রান্তিক জনপদ ঘুরে তুলে আনেন বিপন্ন মানুষের জীবনচিত্র, সমস্যা, সম্ভাবনা, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ পরিস্থিতি, উন্নয়ন-অপউন্নয়ন, নাগরিক সেবা, শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ের খবর। যা প্রকাশ করেন গনমাধ্যমে। তার লক্ষ্য পিছিয়ে পড়া উপকূলবাসীর ভাগ্য বদল। তিনি চান উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সমানভাবে সম্পৃক্ত হোক উপকূলের মানুষেরা। সরকারি বেসরকারি নাগরিক সেবা পৌঁছে যাক প্রান্তিক মানুষের ঘরে ঘরে। তাইতো যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে থাকা উপকূলের অন্ধকার চিত্র তিনি তুলে আনেন প্রকাশের আলোয়। তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন সর্বত্র। এরই পথ ধরে এগোবে উপকূল। সংজ্ঞার নিরিখে দেশের ১৯ জেলা উপকূলীয় জেলা হিসাবে চিহ্নিত হলেও এরমধ্যে ঝুঁকিপূর্ন ১৬টি জেলা নিয়ে কাজ করছেন রফিকুল ইসলাম মন্টু। পূর্বে কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় তটরেখা জুড়েই তার পদচারনা। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি কখনও মাছের আড়তে, কখনো কারও বাড়ির ভাঙ্গা বারান্দায়, কখনো এনজিও গেস্টরুমে, আবার কখনো মাছের ট্রলারে রাত কাটিয়েছেন। তথ্য সংগ্রহের জন্য কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ছুটে চলেন তিনি। কখনো কখনো আবার তথ্য সংগ্রহের ব্যস্ততা কারনে খাবারের কথা ভুলে যান। এমন অসংখ্য নজির রয়েছে। রফিকুল ইসলাম মন্টু দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল ঘুরে সরেজমিন প্রতিবেদন লিখছেন। তার প্রতিবেদনে উঠে আসছে টেকনাফ থেকে শুরু সুন্দরবনেএই দীর্ঘ উপকূলীয় তটরেখার বিভিন্ন বিষয়। উপকূলের অন্ধকার প্রকাশের আলোয় আনতে নিরন্তর চেষ্টা করছেন তিনি। তার প্রতিবেদনের বিষয় হিসাবে উঠে আসছে মানুষের জীবনযাত্রা, পরিবেশ, প্রতিবেশ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, নারী-শিশু, এমনকি সরকারি বেসরকারি সেবা পরিস্থিতির তথ্য-উপাত্ত।
উপকূল নিয়ে ভিন্নধারার রিপোর্টিং: বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উপকূল নিয়ে নিবিড়ভাবে ব্যতিক্রম ধারার রিপোর্টিং শুরু করেন রফিকুল ইসলাম। সমুদ্র উপকূলবর্তী দুর্গম জনপদ ঘুরে রিপোর্টিংয়ের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের তথ্য নীতিনির্ধারক মহলে পৌঁছে দেওয়া। অবহেলায় ডুবে থাকা পশ্চাদপদ উপকূলের চর, দ্বীপ, বিচ্ছিন্ন গ্রাম আর প্রত্যন্ত জনপদের সব খবর উঠে আসছে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে। এরই মধ্যে উপকূলের রিপোর্টগুলো ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। বিচ্ছিন্ন জনপদের সব তরতাজা খবর পাঠককে জানাতে রফিকুল ইসলাম অধিকাংশ সময়ই উপকূলীয় জনপদে অবস্থান করে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। পূর্ব, পশ্চিম ও মধ্য উপকূলের অধিকাংশ এলাকা ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তিনি। এ সময়ে রফিকুল ইসলামের দুর্যোগ, জীবন-জীবিকা, মানবাধিকার, দুর্নীতি, পরিবেশ, সরকারি-বেসরকারি সেবা পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুই শতাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আর এ কাজ করতে গিয়ে তাকে নানা ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখিও হতে হয়েছে। সে সব উৎরে খবরের মূলে গিয়ে তুলে ধরেছেন সবহারা প্রান্তিক মানুষের অসহায়ত্বকে, বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামী জীবনকে।
কাজের ক্ষেত্র: উপকূলভিত্তিক এই রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়, উপকূলীয় ১৫টি জেলা। এগুলো হচ্ছে- পূর্ব উপকূলের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী, মধ্য উপকূলের বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনা, চাঁদপুর এবং পশ্চিম উপকূলের খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। এই উদ্যোগের মাধ্যমে উপকূলের তথ্য উঠে এসেছে নীতিনির্ধারক মহলে। সরকারি-বেসরকারি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
পুরস্কার: কাজের স্বীকৃতি হিসাবে রফিকুল ইসলাম মন্টু জাতীয় পর্যায়ের বেশ কয়েকটি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন। ২০১৫ সালে পিআইবি-এটুআই গণমাধ্যম অ্যাওয়ার্ড, ইউনিসেফ-মীনা অ্যাওয়ার্ড, ২০১৪ সালে ডিআরইউ-গ্রামীণফোন অ্যাওয়ার্ড, ১৯৯৮ সালে পটুয়াখালীর চরাঞ্চলের সরেজমিন সিরিজ প্রতিবেদনের জন্য ‘মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি পুরস্কার’, ২০০০ সালে বরগুনার প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক সিরিজ প্রতিবেদনের জন্য ‘এফপিএবি পুরস্কার’, ২০০১ সালে ভোলার শিশুদের নিয়ে ফিচারের জন্য ‘পিআইবি-ইউনিসেফ ফিচার পুরস্কার’, ২০০৬ সালে দুবলার চরের শিশুদের ওপর অনুসন্ধানী রিপোর্টের জন্য ‘ইউনিসেফ-মীনা অ্যাওয়ার্ড’, একই বছর দক্ষিণাঞ্চলের নদী ভাঙনের ওপর সিরিজ প্রতিবেদনের জন্য ‘ইউএনডিপি-বাংলাদেশ সরকার পুরস্কার’, ২০১০ সালে জলবায়ু পরিবর্তনে বিপন্ন উপকূল বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য ‘কানাডিয়ান অ্যাওয়ার্ড’। এছাড়াও ১৯৮৮ সালে বরগুনা জেলা পর্যায়ে ‘একুশে সাহিত্য পুরস্কার’ ও ‘জাতীয় তরুণ সংঘ পুরস্কার’ অর্জন করেন তিনি।
বই: উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের ওপর তথ্যভিত্তিক ‘সিডর: বিপন্ন জনপদের বিবর্ণ রূপ’ বই লিখেছেন তিনি। মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘পটুয়াখালীর চরাঞ্চলের জীবনযাত্রা ও মানবাধিকার’ শীর্ষক সিরিজ প্রতিবেদন সংকলন করে বই প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে।
গবেষণা: সরকারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে ২০১০ সালে ‘উপকূলীয় অঞ্চলে সিডর আক্রান্ত জনগনের জীবন সুরক্ষায় কৌশল উদ্ভাবন’, ২০০৮ সালে ‘সমুদ্রগামী মৎস্যজীবীদের জীবন জীবিকা’ এবং ২০০৪ সালে ‘উপকূলীয় জেলা বরগুনায় তৃণমূলস্তরের নারীর ক্ষমতায়নে ইউপি নারী সদস্যদের ভূমিকা বিষয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেছেন সাংবাদিক ও গবেষক রফিকুল ইসলাম। এছাড়া বরগুনা জেলা পর্যায়ে টোটাল লিটারেসি মুভমেন্ট (টিএলএম), বেড়িবাঁধে রুটিন মেইনটেন্যান্স কার্যক্রম (আরএমপি) ও ইউনিসেফের ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি (ওআরটি) বিষয়ে প্রভাব যাচাই গবেষণা করেছেন।
ফেলোশিপ: রফিকুল ইসলাম ‘উপকূলীয় এলাকায় সর্বজনীন সম্পদ ব্যবহার’ বিষয়ে সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট (সিএফএসডি)’র অধীনে ফেলোশিপ করেছেন ১৯৯৩ সালে।
কর্মরত গণমাধ্যম: উপকূলের আয়না হিসাবে পরিচতি রফিকুল ইসলাম মন্টু স্কুলে বরগুনা জিলা স্কুলে অধ্যায়নকালে নিজ জেলা বরগুনা থেকে সাংবাদিকতা শুরু করেন। নিজের লেখা খবর দিয়ে তৈরি করতেন দেয়াল পত্রিকা। নাম ছিল ‘‘সাপ্তাহিক প্রগতি’’। তার সাংবাদিকতার চর্চা শুরু হয় সেখান থেকেই। আনুষ্ঠানিক হাতে ঘড়ি ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নবঅভিযান পত্রিকায়। পত্রিকাটি পরে দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। এরপর তিনি পর্যায়ক্রমে দৈনিক দেশ, দৈনিক জনতা, বার্তা সংস্থা ইউএনবি, বাংলাদেশ টাইমস, বাংলাবাজার পত্রিকাসহ কয়েকটি পত্রিকায় জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। অাশির দশকের শেষের দিকে বরগুনা থেকে প্রাকাশিত সাপ্তাহিক বরগুনা কণ্ঠ ও দৈনিক আজকের কণ্ঠ পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় বাংলাবাজার পত্রিকার বরগুনা ব্যুরো অফিসের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৯৭ সালে দৈনিক মানবজমিনে বরিশাল অঞ্চলে স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে যোগ দেন তিনি। ২০০২ সালে পেশাগত প্রয়োজনে ঢাকার মূলধারার সাংবাদিকতায় যুক্ত হন রফিকুল ইসলাম মন্টু। যোগ দেন দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ঢাকা অফিসে। পর্যায়ক্রমে ঢাকায় দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক সমকাল, দৈনিক কালের কণ্ঠ, দৈনিক প্রথম আলো, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে গণমাধ্যম বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ম্যাস-লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি)’র কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন তিনি।
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া ফেসবুকে রফিকুল মন্টু
0Share