জিল্লুর রহমান: লক্ষ্মীপুর বাংলাদেশের একটি উপকূলীয় জনপদ। চরাঞ্চল ও প্রত্যন্ত গ্রাম এ অঞ্চল কে সম্মৃদ্ধ করেছে। মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের কুল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এ জনপদ খুব প্রাচীনকাল থেকেই ইলিশ, নারিকেল, সুপারির জন্য সারাদেশে বিখ্যাত। তবে বিগত প্রায় সাড়ে ৩ দশক ধরে অর্থকরি ফসল হিসেবে সয়াবিন এ অঞ্চল কে ভিন্নভাবে পুরো দেশে পরিচিত করিয়ে দিয়েছে। সে সূত্র ধরেই ২০১৬ সাল থেকে জেলা ব্র্যান্ডিং হিসেবে লক্ষ্মীপুর কে সয়াল্যান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করে লোগো ও স্লোগান দিয়ে এখন সয়াল্যান্ড লক্ষ্মীপুর নামে ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে। একক পণ্য হিসেবে সয়াবিন দিয়ে লক্ষ্মীপুর সারাদেশে পরিচিত করানোর চেষ্টার শুরুতেই যেন কিসের শুন্যতা রয়ে গেছে। অনেকের দৃষ্টিতে শুন্যতার বড়টি হচ্ছে ইলিশ। অন্য দুটি হচ্ছে নারিকেল, সুপারি।
কারণ খুজঁতে গিয়ে জানা যায়, যথেষ্ট সম্ভাবনা এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সঠিক পরিকল্পনার অনুপস্থিতি, শিল্প প্রতিষ্ঠায় অনাগ্রহ, বাণিজ্যিক সম্ভাবনা না চিহ্নিতকরণ ও প্রচারের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক ও শিল্প সম্ভাবনাময় জেলা লক্ষ্মীপুর। নারিকেল, সুপারির সহজলভ্যতার পাশাপাশি সয়াবিন, ইলিশ আর চীনাবাদামের মত অর্থকরি ফসলকে ঘিরে উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপু্র এগিয়ে যেতে পারে সমৃদ্ধির নতুন সোপানে।
কিন্তু এই অঞ্চলের সম্ভাবনা সম্পর্কে অনেকটা উদাসীন আমাদের সচেতন জনগোষ্ঠি। সে প্রসঙ্গে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধাপক মাঈন উদ্দীন পাঠান জানান, আমাদের সয়াবিন এবং ইলিশকে নিয়ে বড় ধরনের একটি বানিজ্যিক সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরী করা সম্ভব। তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, সয়াবিন এবং ইলিশ প্রাচুর্যের জেলা লক্ষ্মীপুরকে আমরা সয়া-ইলিশের রাজধানী হিসেবে ঘোষনা করতে পারি এবং এ ক্ষেত্রে লক্ষ্মীপুর অঞ্চলরে সকল পেশাজীবি, সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পোক্তাদের এগিয়ে আসার আহবান জানান এই শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি মনে করেন নিজস্ব এলাকার উন্নয়নে উদাসীনতা পরিহার করে মনোযোগি হলেই একট নতুন বাণিজ্যিক শহরের স্বপ্ন আমরা দেখতে পারি। কিন্তু এই অঞ্চলের শিল্পপতি-ব্যবসায়িরা নিজ এলাকায় সম্ভাবনা থাকা সত্বেও শিল্প প্রতিষ্ঠায় খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেন না।
একই প্রশ্নে কথা বলেন বেঙ্গল লেদার গ্রুপের এমডি বিশিষ্ট শিল্পপতি টিপু সুলতান। তিনি জানান বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের অপ্রতুলতাই একমাত্র কারন। রায়পুরের রাখালিয়ায় অবস্থিত নিজের শিল্প প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল সু ফ্যাক্টরির উদহারণ টেনে তিনি বলেন, এই ফ্যাক্টরিতে সার্বক্ষনিক বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে যে পরিমান ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং কষ্ট মনে হলে দ্বিতীয় বার এই অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ায় ইচ্ছে জাগে না।
সয়া-ইলিশের রাজধানী হিসেবে লক্ষ্মীপুর অঞ্চলকে ব্র্যান্ডিং করার সংগে তিনি একমত পোষন করে বলেন, ইলিশ এবং সয়াবিনের প্রাচুর্য নিয়ে আমি ভেবেছি, এই দুই অর্থকরি সম্পদকে ঘিরে একটি বড় ধরনের বাণিজ্যিক জোন এখানে প্রতিষ্ঠা হতে পারে। এখন দরকার রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিনিয়োগ কোন সমস্যা নয় বলে তিনি মনে করেন।
বিনিয়োগ যে সমস্যা নয় সেই প্রসঙ্গে একমত হলেন, প্রবাসি বাংলাদেশের মধ্যে কুয়েতের শীর্ষ ব্যবসায়ি মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপের এমডি ও সিইও শহীদ ইসলাম পাপুল। তিনি জানান, সয়াবিন আর ইলিশ, এই দুটি সম্পদকে শিল্প ও বানিজ্যিক চাহিদার নিরীখে পরিকল্পনা মাফিক এর বহুমুখী ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করা যায়, তবে এই অঞ্চল সোনালি আর রুপালি রঙে ভরে উঠবে। সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে একটি বিশেষায়িত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে লক্ষ্মীপুর। আর তখনি সয়া-ইলিশের রাজধানী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করবে এ জেলা। লক্ষ্মীপুরের শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারে তিনি বড় ধরনের বিনিয়োগ করার আগ্রহও প্রকাশ করেন।
ইতোমধ্যে লক্ষ্মীপুর অঞ্চলকে সয়াল্যান্ড হিসেবে ব্র্যান্ডিং করার কাজ হচ্ছে সরকারি ভাবে। কিন্তু সরকারি ভাবে এ জেলার ইলিশের প্রাচুর্যের কথা অস্বীকার করা হয়েছে শুধু জেলাবাসির উদ্যোগ সাংবাদিক এবং সচেতন মানুষের প্রচারণার অভাবে। তাই ইলিশের প্রাচুর্যের ও স্বীকৃতি ফিরে পেতে লেখালেখি ও প্রচারে কাজ শুরু করেছে লক্ষ্মীপুরের অনলাইন গণমাধ্যম লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর। সাথে ইলিশের লক্ষ্মীপুরকে ‘মেইড ইন লক্ষ্মীপুর’ নামে বিশ্বব্যাপি পরিচিত করতে কাজ করেছেন এই অঞ্চলের অন্যতম প্রতিথযশা সংবাদকর্মী সানা উল্লাহ সানু। এই বিষয়ে তিনি অনেক লেখালেখিও করেন।
সানা উল্লাহ সানু বলেন, শুধু সয়াল্যান্ড লক্ষ্মীপুর দিয়ে লক্ষ্মীপুর কে পরিচিত করানো হলে আমাদের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী পণ্য ইলিশ,নারিকেল, সুপারি কে অস্বীকার করা হবে। তার মতে, সয়াবিন একক পণ্য হিসেবে আমাদের থাকতে পারে তবে বাকি ৩টি পণ্য কে বাদ দেয়া যাবে না। তিনি জেলা ব্র্যান্ডিং শ্লোগান সংশোধন করে, “নারিকেল সুপারি ভরপুর সয়া-ইলিশের লক্ষ্মীপুর” রাখার পক্ষে মতামত দেন।তার মতে এতে করে আমাদের বাকি দুটি পণ্য ও মর্যাদা পাবে।জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি আরো জানান ইতোমধ্যে চাদঁপুর নিয়েছে “ইলিশের বাড়ি চাদঁপুর”, এবং বরিশাল নিয়েছে “ধান নদী খাল ইলিশের নিবাস বরিশাল” শ্লোগান। তাহলে আমরা ইলিশ কে বাদ দিবো কেন?
অন্যদিকে ইলিশবাদ দিয়ে আমাদের ব্র্যান্ডিং শ্লোগান যে সঠিক হয়নি তার প্রমাণ হিসেবে, লক্ষ্মীপুর শহরের ঝুুমুর এলাকায় ইলিশ স্কয়ার খ্যাত মুরালের প্রসঙ্গ তুলে আনেন লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর তাদের একটি সংবাদে। তাতে ইলিশের মুরালের উপরে যে লেখা রয়েছে সয়াল্যান্ড লক্ষ্মীপুরে স্বাগতম বিষয়টি বেমানান শ্লোগান হিসেবে উল্লেখ করা হয় ওই সংবাদে।
আমাদের বক্তব্য হচ্ছে এই দায়িত্ব শুধুমাত্র একজন সংবা্দকর্মী বা একটি মাত্র সংবাদপত্রের নয়। আমাদের অঞ্চলের সকল পেশাজীবি এবং সামাজিক সঙ্গগঠন গুলোরও।
এ প্রসংগে ঢাকাস্থ লক্ষ্মীপুর জেলা সমিতির সাধারন সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার ফখরুল হায়দার চৌধুরী বলেন, আমরা অবশ্যই আমাদের ঐতিহ্যকে দেশবাসির কাছে তুলে ধরতে চাই, মেইড ইন লক্ষ্মীপুর বা সয়াল্যান্ড লক্ষ্মীপুর নিয়ে আমরাও কাজ করতে চাই, দুটোর সমন্বয়ে ‘সয়া-ইলিশের লক্ষ্মীপুর’ এই ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেতে যে কোন ধরনের পদক্ষেপ বা কর্মসুচীতে লক্ষ্মীপুর জেলা সমতির সমর্থন থাকবে।
উল্লেখ্য যে ইলিশের প্রাপ্যতার দিক থেকে চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত দীর্ঘ ১০০ কিলোমিটার নদীর ৮০ কিলোমিটারই লক্ষ্মীপুরের সীমানায়। ইলিশ মাছ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই অঞ্চলই শীর্ষে, কিন্তু ইলিশের শহর হিসেবে স্বীকৃতি পেলো চাঁদপুর, বরিশাল। অন্যদিকে সয়াবিন উৎপাদনে বাংলাদেশের শীর্ষ উপজেলা হচ্ছে রামগতি, কমলনগর, রায়পুরের চরাঞ্চল।আবার নারিকেল, সুপারিবিহীন কোন বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলাই নেই।
শেষ কথা হচ্ছে আমাদের সম্পদের প্রাচুর্য আছে, আছে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা, এখন প্রয়োজন নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া, আর সেই এগিয়ে যাওয়ায় ঐতিহ্য এবং সম্ভাবনাময় ব্র্যান্ডিং শ্লোগান হবে “নারিকেল সুপারি ভরপুর সয়া-ইলিশের লক্ষ্মীপুর”।
লেখক: সংবাদকর্মী, ঢাকা।
0Share