জুনাইদ আল হাবিবঃ “মেঘনার ইলিশ তাজা, খেতে খুব মজা”। ইলিশ সম্পদ আর সুস্বাদু ইলিশের রাজধানী বলা যেতে পারে লক্ষ্মীপুরকে। দেশের ইলিশ উৎপাদনের শীর্ষ স্থান লক্ষ্মীপুরের দখলে। কেননা, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ উৎপাদিত হয় মেঘনায়। যার বেশির ভাগ অংশ লক্ষ্মীপুরের সীমানায়। যেখানে ইলিশকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক অঞ্চলের নানান অবকাঠামো। ইলিশ ঘাট, বরফ কারখানা, নৌকা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, জাল, রশি, পুলুটসহ ইলিশ ধরার প্রয়োজনীয় সরাঞ্জাম ক্রয়- বিক্রয়ের প্রতিষ্ঠান এর অংশ। বাড়ছে বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান। জেলে-আড়ৎদাররাও গড়ে তোলেছেন বিভিন্ন ব্যানারে বিভিন্ন সংগঠন। যেগুলো ইলিশ উৎপাদন ও সংরক্ষণে রাখছে বিশেষ ভূমিকা।
সূত্র বলছে, লক্ষ্মীপুরে ইলিশ ঘাটের সংখ্যা ১৫টি! রায়পুরের চরবংশী ঘাট, ও চর আবাবিল ঘাট, জেলা সদরের মজুচৌধুরীর হাট ঘাট, কমলনগরের মতিরহাট ঘাট, বাতিরঘাট, জনতা বাজার ঘাট, চলতা ঘাট, কটরিয়া ঘাট, মাতাব্বরহাট ঘাট, লুধুয়া ঘাট, রামগতির হেতনার খাল ঘাট, আলেকজান্ডার ঘাট, রামগতি ঘাট, সেবাগ্রাম ঘাট, কাইচ্ছারখাল ঘাট উল্লেখযোগ্য।
আর এসব ইলিশ ঘাট থেকে প্রতিনিয়ত মেঘনার রুপালী ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে দেশ- বিদেশের মাটিতে। সরকারি কোষাগারে জমছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। বদলে যাচ্ছে দেশের চিত্র। ইলিশ সম্পদ এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত “বাংলাদেশী ব্যান্ড” হিসেবে। সেক্ষেত্রে লক্ষ্মীপুরের এই বিরাট সম্ভাবনাময় অঞ্চল কতটুকু মূল্যায়ন হচ্ছে? যেখানে ইলিশকে কেন্দ্র করে অফুরন্ত সম্ভাবনা ডানা মেলেছে। কর্মসংস্থান হচ্ছে বেকার যুবকদের, জীবিকা নির্বাহ করছে অসংখ্য অগণিত জেলেরা। গড়ে তোলা হচ্ছে প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো। জেলের তুলনায় জেলে কার্ডের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। যখন ইলিশ সংরক্ষণের অভিযান আসে, তখন জেলেদের মনে বেড়ে যায় দুঃচিন্তা। টানা কয়েক মাস ইলিশ ধরা বন্ধ থাকে। এক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেদের জন্য নেই কোন বিকল্প কর্মসংস্থান। তখন বাধ্য হয়ে জেলে পরিবারগুরো চড়া সুদে ঋণ নেয় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে। সংসারে বাড়ে দুঃচিন্তার পাহাড় আর হাহাকার।
জেলেদের সরকারের বরাদ্ধকৃত চাল পৌঁছেনা সময়মতো। জেলে বেশি, কার্ড কম! অনেক সময় অভিযোগ উঠে কার্ড থাকলেও চাল না পাওয়ার! এক্ষেত্রে জেলেদের উন্নয়নেও বিশেষ নজর রাখা জরুরী। উপকূলের এমন সম্ভাবনার চিত্র দেশের অর্থনীতিতে যেমন বিরাট ভূমিকা রাখছে, তেমনি দরিদ্র জেলে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নেও এর ভূমিকা কম নয়। ইলিশ আড়তের মালিক, হিসাব রক্ষক, নিলামওয়ালা, বরফ কারখানার মালিক, শ্রমিকদের জীবনের বিকাশ ঘটে এর মাধ্যমে। লক্ষ্মীপুরের ইলিশ কেবল ঢাকা ও দেশের জেলায় রপ্তানিতে সীমাবদ্ধ নয়, আন্তর্জাতিক বাজারে এ অঞ্চলের ইলিশের রয়েছে অনেক গুরুত্ব। তাজা রুপালী ইলিশ দেখতেও যেমন জীবন্ত, তেমনি খেতেও ভারি মজা লক্ষ্মীপুরের মেঘনার সুস্বাদু ইলিশ। কেউ ট্রলারে করে, কেউ বড় নৌকায় করে, কেউবা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে ছুটে চলে মেঘনার মোহনায়। অনেকে আবার বড় ইলিশের আশায় পাড়ি দেয় গভীর মেঘনায়। জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে তাদের ইলিশ সংগ্রহের পর টাটকা ইলিশ ছেড়ে দিতে নিলামে। নিলামওয়ালার দামের ওপর নির্ভর করে ক্রয়-বিক্রয় ঘটে ইলিশের। কখনো ইলিশ কেনা ভিড় জমে সাধারণ ক্রেতাদের কখনোওবা ভিড় লেগেই থাকে ক্ষুদ্র ও বড় ব্যবসায়ীদের।
দেশের চারটি ইলিশ ঘাটের শীর্ষ স্থান দখলকারী লক্ষ্মীপুর মতিরহাট ইলিশ ঘাট। ইলিশ ঘাটটির সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি সদস্য তরুণ উদ্যমী মেহেদী হাসান লিটন বলেন, “আমাদের মেঘনায় প্রচুর পরিমাণ ইলিশের উৎপাদন হয়। সেক্ষেত্রে ইলিশ সুরক্ষায় ভালো কোন প্রদক্ষেপ। ইলিশ ধরা নিষেধাজ্ঞার সময়ও অন্যান্য অঞ্চলের জেলেরা লক্ষ্মীপুরের সীমানায় এসে ইলিশ করে। তাছাড়া এই ইলিশ সম্পদ রপ্তানিজাত করতে যোগাযোগ ব্যবস্থার চরম অবনতি আমাদের পদে পদে দুর্ভোগের মাত্রা বাড়িয়ে তোলছে”।
সূত্র বলছে, ইলিশ উৎপাদনে এগিয়ে লক্ষ্মীপুরের মেঘনা। চাঁদপুরের হাইমচরের ভৈরবী ইলিশ ঘাট এবং নোয়াখালীর চেয়ারম্যান ঘাটের অধিকাংশ ইলিশ আসে মেঘনার লক্ষ্মীপুরের সীমানা থেকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য,লক্ষ্মীপুরবাসীর নিরবতায় সরকার চাঁদপুরকে ইলিশের জন্মস্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইলিশের এমন সম্ভাবনা কোন মতেই হাতছাড়া করে রাজি নন বিভিন্ন সামাজিক,সাংস্কৃতিক, সাংবাদিক,লেখক ও উন্নয়ন মনস্করা। সকলের দাবি একটাই “ইলিশ মেইড ইন লক্ষ্মীপুর”।
বাংলাদেশের উপকূল সাংবাদিকতার পথিকৃত “উপকূল বন্ধু” রফিকুল ইসলাম মন্টু। গ্রামের বাড়ি উপকূলীয় জেলা বরগুনায়। খবরের সন্ধানে বিচরণ উপকূলের ৭১০ কিলোমিটার তটরেখায়। লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোরকে বলছিলেন, লক্ষ্মীপুরের মেঘনার ইলিশ বেশ সুস্বাদু। যা সম্ভাবনাময় উপকূলের দুয়ার খুলছে। যেখানে এলে জেলে সম্প্রদায় ও তাদের সাথে জড়িত কর্মজীবীদের জীবনমান বদলে যাওয়ার দৃশ্য উপলব্দি করি। আমি লক্ষ্মীপুর গেলে প্রায় ইলিশ খেয়ে থাকি। এ বিরাট সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দান এখন সবচেয়ে বড় বিষয়।
সাংবাদিক ও সাহিত্যিক, জেলার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ লক্ষ্মীপুর সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ মাইন উদ্দিন পাঠান লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোরকে বলেন,
“আমাদের সম্ভাবনার ইলিশ দেশীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলছে। যেভাবে সয়াল্যান্ড হিসেবে লক্ষ্মীপুর পরিচিত পেয়েছে ঠিক সেভাবে ইলিশের উৎপাদন, সরবরাহ এবং রপ্তানিতে লক্ষ্মীপুরের অবস্থান কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। মোটকথা সয়া-ইলিশের ল্যান্ড হিসেবে লক্ষ্মীপুরকে বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।”
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম মুহিবুল্লাহ অবশ্য লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোরকে বলছিলেন,
“ইলিশের উৎপাদনের জন্য লক্ষ্মীপুরই সেরা। যেখানের মেঘনায় এখন ইলিশ ধরা পড়ছে প্রচুর পরিমাণে। আর এসব ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণের কথা বিবেচনা আগামি ১-২২ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ ধরা, মজুদ, পরিবহন ক্রয়- বিক্রয় সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ করছে। ইলিশ সংরক্ষণের জন্য ইতিমধ্যে জেলা মৎস্য অফিস থেকে নানান প্রদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যার মাধ্যমে লক্ষ্মীপুরের সম্ভাবনার ইলিশ সম্পদ রক্ষার বহুমূখী প্রচেষ্টা চালানো হবে।”
[author image=”https://encrypted-tbn0.gstatic.com/images?q=tbn:ANd9GcSIhtzsGe1imQEowQkynxIHALGZYF9JBR2zymJ81dWF0W4eaNAzIw” ] এ প্রতিবেদনটির প্রতিবেদক জুনায়েদ আল হাবিব লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোরের শিক্ষানবীশ কন্ট্রিবিউটর। পাশাপাশি পড়ছেন লক্ষ্মীপুর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। সমাজের নানা সমস্যার কথা সামাজিক ও মূলধারার গণমাধ্যমে তুলে ধরতে তিনি পছন্দ করেন।বাংলাদেশের উপকূল নিয়ে কাজ করতে তার আগ্রহ। [/author]
0Share