কাজ করতে নাই চাইলেই রুমে আটকে রেখে মারতো। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতো। খাবার দাবার দিতো না। পরে ক্ষুদার যন্ত্রনায় আবার কাজ করতে চাইলে ৩’শ দিনার দিয়ে কাজ করতে হতো। আমাদেরকে মাসে ১৪০ দিনার বেতন দেয়ার কথা থাকলেও কুয়েতে এসে দেখি মাসে নব্বই দিনারও আয় হয় না।
উল্টো প্রতিদিন পাপলুর লোকজনকে দশ দিনার করে দিতে হতো। এবার যত টাকা আয় হয় সেটা তারা দেখতো না। এই দু:খ কাকে বলবো। এই কষ্ট কাকে দেখাবো। বলছিলেন কুয়েত ফিরত ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার শাহ আলম। মুদ্রা ও মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার বাংলাদেশি সাংসদ মোহাম্মদ শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কুয়েতি আদালতে সাক্ষী দেয়া বাংলাদেশী প্রবাসীদের মধ্যে শাহ আলম অন্যতম।
ওই সাংসদের অভিযোগের ব্যাপারে ১১ প্রবাসী বাংলাদেশির সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। ওই ১১ জনের সবাই সাংসদের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ আনার পাশাপাশি প্রতিবছর বছর ভিসা নবায়নের জন্য বাড়তি টাকা নেয়া, প্রতিদিন উপার্জনের একটি অংশ নেয়ার অভিযোগ এনেছেন। সোমবার রাত তিনটায় কাতার এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে ওই ভোক্তভোগীরা দেশে ফিরেছেন। কুয়েতের সিআইডি তাদের আটক করে এবং জবানবন্দি রেখে দেশে পাঠিয়ে দেন ।
মঙ্গলবার (১৬ জুন) রাতে বাংলাদেশী ইংরেজী দৈনিক দ্যা বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাড দেশে ফেরত ওই ১১ বাংলাদেশীর বক্তব্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
দ্যা বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাড এর প্রতিবেদনটি অনুবাদ করে লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোরের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
শাহআলম বলেন ,গত বছরে রোজার ঈদের পরেই আমাকে কুয়েতে নেয়া হয়। সাড়ে সাত লাখ টাকা ধারদেনা করে টাঙ্গাইলের রাশেদ নামে একজনকে আমি টাকা দেই। রাশেদ কাজী পাপলু সাহেবের কোম্পানীর পাপলুর কাছের লোক। আমাকে মাসিক বেতনের কথা বলে নেয়া হয়েছিলো। কিন্তু এখানে এসে দেখি উল্টো নির্যাতন। আমাকে কুয়েতের এয়ারপোর্টে ব্যাগ ও মালামাল টানার কাজ দেয়া হয়। এসব কাজ করলে কুয়েতিরা এক দুই দিনার দিতো। এতে প্রতিদিন তেরো, চৌদ্দ দিনার আয় হতো। কিন্তু পাপুল সাহেবের লোকজনকে এখান থেকে প্রতিদিন দশ দিনার দেয়া লাগতো।
পাপলুর কোম্পানী সুপারবাইজার ব্রাক্ষনবাড়িয়ার সামাদ ও কুমিল্লার মাহবুব এই দুইজন এসে প্রতিদিন আমাদের কাছ থেকে দিনার নিয়ে যেতে। যার কারনে সারাদিন কাজ করার পর থাকতো দুই দিনার তিন দিনার। এসবের প্রতিবাদ করলেই তারা নির্যাতন করতো , কাজ বন্ধ করে দিতো। পরে যখন আবার কাজের জন্য যেতাম তিন’শ দিনার দিয়ে কাজ করতে হতো। এ বলেই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কান্না করছিলেন শাহআলম। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশি সাংসদ পাপুলকে গ্রেপ্তারের দুই দিন পর ৮ জুন তাদেরকে আটক করে কুয়েতের সিআইডি।
তিনি বলেন, সিআইডি যেদিন আমাদের আটক করতে আসে, সেই দিন তারা আমাদের বলেছিলো তোদের যে টাকা ক্ষতি হয়ে সেইগুলো তুলে দিবো।এই বলে আমাদের বারোজনকে তুলে নিয়ে যায়। পরে অবশ্য একজন পালিয়ে যায়। আমাদের ১২ জনকে একটি কক্ষে রাখা হয়েছিলো।
কোর্টে স্বাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন , আমাদের তিনটি প্রশ্ন করা হয়েছিলো। আমাদের কাছ থেকে পাপুলের কোম্পানী টাকা নিয়েছে কিনা, তারপর এখানে শর্তমোতাবেক কাজ দিয়েছে কিনা এবং মাসিক বেতন দেয় কিনা। আমরা যা সত্য তা বলেছি। কোনো মিথ্যা কথা বলিনি।
ভোক্তভোগী শাহআলমের কাছে প্রশ্ন ছিলো , পাপুলের সঙ্গে কখনো তাদের দেখা হতো কিনা, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন , এয়ারপোর্টে প্রায়সময় দেখা হতো। কিন্তু তাকে সালাম দেয়া তার সঙ্গে কথা বলা সম্পূর্ন নিষেধ ছিলো। এয়ারপোর্টে তাকে সালাম দিলেই চাকরি চলে যেতো। নির্যাতন করতো। শাহআলম বলেন , এই লকডাউনের সময় চার মাস কাজ ছাড়া ছিলাম। আমাদের কেউ দেখতে আসেনি। খাবার দেয়নি। চারপাঁচ দিন না খেয়ে ছিলাম। যারা এমন অবস্থায় কখনো ছিলো না, তারা ক্ষুদার যন্ত্রনা কি বুঝবে না। পরে বাড়ি থেকে চল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে জীবনটা কোনোরকম বাচিয়ে রেখেছি।
আরেক স্বাক্ষী নোয়াখালির চাটখিল উপজেলার মো. সোহাগ বলেন, আমি দুই বছর আগে ফকিরাপুল পাপলুসাহেবের অফিসে মনিরকে সাত লাখ দিয়ে কুয়েত যাই। আমাদেরকে ১২ঘন্টা কাজ ও ১৪০ দিনার দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কুয়েত যাওয়ার পর ১৭ ঘন্টা কাজ করতে হয়েছে। আমি একটা মার্কেটে কাজ করেছি। সেখানে সবমিলেয়ে নব্বই থেকে এক’শ দিনার পেতাম। এর মধ্যে প্রতিদিন পাপুল সাহেবের কোম্পানির লোকজন এসে চার দিনার করে নিয়ে যেতো। টাকা না দিলে নির্যাতন করতো। এসবের প্রতিবাদ কেউ করতে পারতো না। এই লকডাউনের সময় আমাদেরকে কুয়েতের কাবাত মরভূমির একটি জায়গায় রাখা হয় যেখান থেকে আমাদেরকে সিআইডি ধরে নিয়ে যায়।
পরে গত বৃহস্প্রতিবার আমাদের কোর্টে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে আমরা স্বাক্ষ্য দেই। আমাদেরকে জিঙ্গেস করা হয় কিভাবে , কত টাকা দিয়ে এসেছি, কি কাজ দেয়ার কথা ছিলো বা কি কাজ দিয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম আমরা। সিআইডি আমাদেরকে আগেই থেকে বলেছিলো, তাদেও কাছে যা বলেছি কোর্টেও যেনো তা বলি। এই কথার ভিত্তি করে প্রায় ছয় পাতা লেখা হয়। কুয়েতে কেমন জীবন ছিলো এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, জায়গাজমিন বিক্রি করে সাত লাখ টাকা খরচ করে গিয়ে যে এমন অবস্থা হবে, কল্পনা করিনি।
তারপরও এতো টাকা খরচ করে আসছি তাই নির্যাতন সহ্য করেছি কষ্ট করে টাকা উপার্জন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুই তো হলো না। এখন আমার কি হবে? সিআইডি টাকা আদায় করে দেয়ার কথা বলে আটক করেছে তাদেরকে। পরে টাকা দিয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন,আমাদের প্লেইনে তোলার সময় সিআইডি কাউকে আড়াই’শ দিনার কাউকে দুই’শ দিনার দিয়েছে। তখন তারা বলেছে এই টাকা কোম্পানী থেকে বেতন ও কিছু আদায় করে দিয়েছে ।
উল্লেখ্য গত ৬ জুন মানবপাচার ও অর্থপাচারের অভিযোগে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল কুয়েতের সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হয়। দেশটির মুশরেফ আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেন। অভিযোগ রয়েছে পাপুল নিজের নামে কিছুই করেন না। তিনি বিভিন্ন সাব-এজেন্টের মাধ্যমে মানবপাচার করিয়ে থাকেন। বিশেষ করে ক্লিনিং এবং সিকিউরিটির কাজের নামে তিনি এই মানবপাচার করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাপুল যে শুধু অবৈধ পথে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত তা নয়, তিনি যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন সব জায়গাতেই নিজের তথ্য গোপন রেখে ব্যবসা করেন
0Share