লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাঙ্খিত সেবা পেয়ে রোগীদের ভিড় বাড়ছে । নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালটি। লক্ষ্মীপুর টুয়েন্টিফোর ডট কমে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কামনাশিস মজুমদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লক্ষ্মীপুর টুয়েন্টিফোর ডট কমের সিনিয়র রিপোর্টার মিসু সাহা নিক্কন। পাঠকদের জন্য কথামালার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
লক্ষ্মীপুর টুয়েন্টিফোর: আপনার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে কিছু বলুন
ডা. কামনাশিস মজুমদার : ২০০৭ সালে ২০ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে এটি ৩১ শয্যা হাসপাতালে উন্নীত করা হয়। কিন্তু অবকাঠামো এখনো ২০ শয্যার রয়েছে। পৌনে ৩ লাখ মানুষের আবাসস্থলে এই হাসপাতালটি একমাত্র ভরসা। জনগণের তুলনায় অবকাঠামো ও জনবল অপ্রতুল। কাগজে-কলমে ৩১ শয্যা হাসপাতালটি দ্রুত অবকাঠামোর দিক দিয়ে বাস্তবে রূপ দেয়া জরুরি।
লক্ষ্মীপুর টুয়েন্টিফোর: আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
ডা. কামনাশিস মজুমদার : আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে হাসপাতালে প্যাথলজি সেবা, এক্স-রে সেবা, গর্ভবতী মায়েদের আলট্রাসাউন্ড, প্রতি শনিবার জরায়ু মুখের ক্যান্সার পরীক্ষার জন্য ভায়া টেষ্ট, সিজারিয়ান ডেলিভারি, আধুনিক ডেন্টাল সেবা (ডেন্টাল এক্সরে সহ), টিবি রোগীদের সর্বাধুনিক চিকিৎসা জিন এক্সপার্ট মেশিন চালু, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু কর্নার চালু করেছি। যদিও প্যাথলজি ও এক্স-রে মেশিন পরিচালনার জন্য কোন টেকনিশায়ন পদায়িত নাই, তারপরেও উপজেলা পরিষদের সাথে সমন্বয় করে এই সেবাগুলো চালু করেছি।
সম্প্রতি রামগতি উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপজেলা পরিচালন ও উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউজিডিপি) আওতায়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) যৌথ অর্থায়নে উপজেলা প্রকৌশলীর দপ্তর, এলজিইডি,রামগতির কারিগরি সহায়তায় ওয়াটার এ্যাম্বুলেন্স ক্রয় করা হয়। যা রামগতির স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে এটি একটি মাইলফলক। এর সুফল পাবে দুর্গম চরাঞ্চলের অবহেলিত মানুষগুলো।
লক্ষ্মীপুর টুয়েন্টিফোর: উপকূলীয় এলাকার স্বাস্থ্যসেবার মান-উন্নয়নে কোন কোন বিষয় বিশেষ জোর দেওয়া জরুরি?
ডা. কামনাশিস মজুমদার : শূন্য পদে জনবল নিয়োগ সময়ের দাবি। যদি শূন্য পদগুলো পূরণ করা যায়, তাহলে সেবার মান বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া অবকাঠামোর দিকতো রয়েছেই।
লক্ষ্মীপুর টুয়েন্টিফোর: সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্য গ্রহীতার উপস্থিতি কেমন?
ডা. কামনাশিস মজুমদার : আগে হাসপাতালে রোগীরা কম আসতো। অনেক রোগী নোয়াখালী চলে যেত। কিন্তু হাসপাতালে সেবাগুলো চালুর পর রোগীর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে মোট রোগীর সংখ্যা ছিলো ৬৭,০০০ হাজার যা ২০২১ এ গিয়ে দাঁড়ায় ১,০৭,৫৪৩ জনে।
লক্ষ্মীপুর টুয়েন্টিফোর: আপনার হাসপাতালে কতটি পদ রয়েছে, এর মধ্যে কত পদ খালি আছে ? শূন্যপদের চিকিৎসকদের অভাব কিভাবে পূরণ করছেন?
ডা. কামনাশিস মজুমদার : মেডিক্যাল অফিসার পর্যাপ্ত আছে। কিন্তু কনসালটেন্টের পদগুলো শূন্য। যদিও এ্যান্সেসথিশিয়ার কনসালটেন্ট আছে। কিন্তু গাইনী, মেডিসিন, সার্জারী, শিশু কনসালটেন্ট নাই। আর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জনবল নাই বললেই চলে। এ কারণে হাসপাতালের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রায়ই নেগেটিভ মন্তব্য করে থাকেন এলাকাবাসী। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জনবলের অভাব আমরা স্থানীয় উদ্যোগেই ব্যবস্থা করছি।
লক্ষ্মীপুর টুয়েন্টিফোর: আপনার হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী ও কুকুরে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে কি?
ডা. কামনাশিস মজুমদার : কুকুরে কামড়ের চিকিৎসা এখানে করা হয়। কুকুরের ভ্যাকসিন সরকারীভাবে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর চালু করেছি। কিন্তু সাপে কাটা রোগীদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। কারণ কোন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এখানে নেই।
লক্ষ্মীপুর টুয়েন্টিফোর: আপনার হাসপাতালে কোন রোগী সংখ্যা বেশি ?
ডা. কামনাশিস মজুমদার : হাসপাতালে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, RTA রোগী বেশি আসে।
লক্ষ্মীপুর টুয়েন্টিফোর: দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনও কোনো ধরনের প্রতিকূলতার সম্মূখীন হয়েছেন কিনা? হয়ে থাকলে কীভাবে তা মোকাবেলা করেছেন?
ডা. কামনাশিস মজুমদার : প্রতিকূলতা বলতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। বাথরুমের অবস্থা খুব খারাপ ছিলো। পরবর্তীতে উপজেলা পরিষদ থেকে ৪ টা বাথরুমের ব্যবস্থা করা হয়। আর স্থানীয় এমপি মহোদয়ের অর্থায়নে ৭ জন আউটসোর্সিং এর লোক হাসপাতালে কাজ করছে। বর্তমান পরিবেশ অনেকটা ভালো।
লক্ষ্মীপুর টুয়েন্টিফোর: চিকিৎসকদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?
ডা. কামনাশিস মজুমদার : রামগতি একটি প্রান্তিক উপজেলা। নদী ভাংগন কবলিত এলাকা। শিক্ষার হার ৩৭%। এত প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্বেও টিম রামগতি সেবার যেই দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছে- এটা যদি সব স্বাস্থ্য ক্যাডার কর্মকর্তারা যদি নিজ নিজ দায়িত্ব থেকে পালন করেন, তাহলে সরকারি হাসপাতালের উপর মানুষের যে বিরূপ মনোভাব আছে, তা অনেকটা দূরভীত হবে।
গত দুই বছরের মধ্যে হাসপাতালটিতে আমূল এই পরিবর্তন এসেছে। এর নেপথ্য নায়ক একজন চিকিৎসক। তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কামনাশিস মজুমদার। তিনি মনে করেন, ‘পরিচ্ছন্ন পরিবেশ’ই সেবা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে সরকারি হাসপাতাল সম্পর্কে ধারণা পাল্টে দেবে।
সরেজমিনে একদিন: গত ২০ অক্টোবর সকালে হাসপাতাল চত্বরে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছিমছাম সবুজ চত্বর। ড্রেনগুলোও পরিষ্কার। ময়লার ভাগাড় এখন ফুলের বাগান। ভবনের সামনে এমন বাগান করা হয়েছে। উৎকট গন্ধের বদলে বাতাসে ভেসে আসে ফুলের সুবাস। মূল ফটক থেকে ভবনের সামনের চত্বর পর্যন্ত সারি সারি বাহারি রঙের বৈদ্যুতিক বাতি। ভবনে ঢুকতেই টিকিট কাউন্টার। সামনে সেবাপ্রত্যাশী মানুষের ভিড়। টিকিট বিক্রেতার দম ফেলার ফুরসত নেই। হেল্পডেস্কের সামনেও ভিড়। মাথার ওপরে ঝুলছে ডিজিটাল সাইনবোর্ড। তা জানান দিচ্ছে বিভিন্ন সেবার বার্তা।
সেবায় সন্তুষ্টি: বেশ কিছু রোগীরা জানান, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালেই করাতে পেরেছেন। ওষুধপথ্যও হাসপাতাল থেকে পেয়েছেন। কেবিনের মেঝে ও দেয়ালে টাইলস লাগানো। শৌচাগারও পরিচ্ছন্ন। সেবার প্রশংসা করলেন রিক্সা চালক জসিম উদ্দিন, তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক ও নার্সরা নিয়মিত আমার খোঁজখবর নিচ্ছেন। সবচেয়ে ভালো লেগেছে হাসপাতালের দুর্গন্ধমুক্ত পরিবেশ।’ এখানে বেসরকারি হাসপাতালের মতোই সেবা পেয়ে প্রশংসা করলেন আরও অনেকে। হাসপাতালে দালালদের দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। নেই ওষুধ কোম্পানির লোকজনের অবাধ উপস্থিতিও। গোটা হাসপাতাল এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কামনাশিস মজুমদার বলেন, প্রতি সোমবার ও মঙ্গলবার সিজারিয়ান ডেলিভারির ব্যবস্হা বর্তমানে রয়েছে। হাসপাতালে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। হাসপাতালের সামনে ফুলের বাগান ও রাতে পুরো হাসপাতালের পর্যাপ্ত আলো হাসপাতালের শোভা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। রোগীরা যাতে সর্বোচ্চ সেবা পেতে পারে তার জন্য প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের জন্য ইন্টারকমের ব্যবস্হা রয়েছে। বর্তমানে এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উত্তীর্ণকরণ।
মিসু সাহা নিক্কন/10/22
0Share