খায়রুল বাশার আশিক: এদেশে অনেক উপকূলীয় প্রান্তিক গ্রাম আছে যেখানে বিদ্যুতের ছোঁয়া পৌছায়নি, চলাচলের জন্য নেই কোন পাকা রাস্তা। সেই দূর্গম এলাকার মানুষের খোঁজ নিতে বরাবর পৌছে যায় দুটি পা। আইনে অজ্ঞতা, অধিকার অসচেতনতা,খরা- বন্যা- লবণাক্ততা, কুসংস্কার, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের মত সমাজ কেন্দ্রিক এসব বিষয়গুলো উপকূলীয় সমাজের সামাজিক গতিশীলতার পথকে রুদ্ধ করে রাখা সেই উপকূলের মানুষের খোঁজ নিতে তাদের ঘরের অঙ্গিনায় পৌছে যাওয়া মানুষটি হচ্ছেন রফিকূল ইসলাম। তার ডাক নাম মন্টু। উপকূলের ৭১০ কিমি বঙ্গোপসাগরের তটরেখার লাগোয়া উপকুলীয় জেলাগুলোর বিভিন্ন উপজেলায় তাকে অনেকেই চেনে মন্টু ভাই হিসেবে।
উপকূলীয় জেলা বরগুনায় জন্ম নেয়া রফিকুল ইসলাম মন্টু পেশায় একজন সংবাদকর্মী। দেশের নেতৃত্বস্থানীয় অনেক সংবাদপত্রের বিভিন্ন বিটে কাজ করেছেন রফিকুল ইসলাম মন্টু। একসময় তিনি অনুধাবন করতে শুরু করেন উপকূলীয় মানুষের কষ্টে ভরা জীবনের গল্পগুলো। এরপর তিনি লেখা শুরু করেন উপকূলের মানুষের জীবন নিয়ে। একাধিক গণমাধ্যমে তার লেখনীতে উঠে আসতে শুরু হয় উপকূলের মানুষের বেঁচে থাকার সেই যুদ্ধ চিত্র। তার পেশার সবটা জুড়েই নেশার মত আটকে যায় উপকূল ও উপকূলীয় জনগণের জীবনধারা। তার লেখনীর সবটা জুড়েই প্রাধান্য পায় উপকূলীয় জনগনের বাস্তবিক জীবনধারার গল্প এবং উপকূলীয় সমস্যা ও সম্ভাবনা।
সাংবাদিকতার হাতেখড়ির বয়সেই তার ভেতরে উপকূল সাংবাদিকতার বীজ বপন হয়৷ তার সাংবাদিকতা শুরুই হয় উপকূল সাংবাদিকতা দিয়ে৷ সেই সময়ে নিজের গ্রাম নিয়ে সিরিজ প্রতিবেদন লিখেন৷ তখন স্কুলে পড়েন৷ যাত্রা শুরুর সময়টা সেই থেকে গননা করলে তার উপকূল সাংবাদিকতার পথটা অনেক লম্বা৷
উপকূলীয় জেলাগুলোর পড়তে পড়তে পৌঁছে যায় রফিকুল ইসলাম মন্টুর দুই পা। হাজার হাজার মানুষের নুন-পান্তার গল্প জানতে ও জানাতে শুরু করে তিনি। প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি বেছে নেয় অনলাইন মিডিয়াগুলোকেও। তার রিপোর্টে উঠে আসে গ্রামীণ কৃষির সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা। কিভাবে একজন মানুষ হয়েও পশুর মত কষ্ট করে পেট চালায় উপকূলের মানুষগুলো, কিভাবে বন্যায় ভেসে থাকে সেই কলাবগী কিংবা আন্ডারচরের মানুষগুলো, কিভাবে অনাহারে অর্ধাহারে বেঁচে থাকে ইলিশ পল্লীর জেলেরা, ঢালচর কিংবা বলেশ্বর তীরের মানুষের কান্না, জলদাশ পরিবারের কথা, কেমন করে চলে সাতক্ষীরার বাঘ বিধবাদের জীবন, উরিরচর- দ্বিপ মদনপুর- কমলনগর- চর মদনমোহন- চর রামদাসপুর বা ঢালচরের মানুষের কঠিন জীবনের গল্প, বেদে-মান্তার নৌকায় বসত জীবনের গল্পগুলো মানুষ জানতে পারে মন্টু ভাইয়ের লেখার মধ্য দিয়ে। এতো কটা উদাহরণ মাত্র, তার প্রতিটি লেখাই যেন উপকূলীয় মানুষের ভাগ্যবার্তা। তার সংবাদ সংগ্রহের বর্তমান ক্ষেত্র শুধুই উপকূল। তার প্রতিবেদনে উঠে আসে মানুষের জীবনযাত্রা, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ-প্রতিবেশ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, নারী-শিশু, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সরকারি বেসরকারি সেবা পরিস্থিতি।
শুধুই লেখা দিয়ে নয়, উপকূলীয় মানুষের জন্য তিনি একজন ইন্টারনেট মন্টু। নিজের পিঠে ব্যাগে থাকা ল্যাপটপটা সর্বদাই ব্যবহার করতে দেয় উপকূলের জনগনের যে কোন প্রয়োজনে। অনেকেই কিছু বুঝতে বাঁ জানতে উপকূল থেকে রাত- বিরাতে ফোন দিলেও পাওয়া যায় মন্টু ভাইকে। মাঝি নূর উদ্দিন, আইনুদ্দিন, হাফিজ উদ্দিন সহ এমন অনেকেই কোনো প্রয়োজনে ফোন করে গভীর রাতের ঘুম কেড়ে নিলেও রাগ করেন না মন্টু। উপকূলের মানুষের জানা ও জানানোর সহজ মাধ্যম এখন রফিকুল। এ যেন উপকূলের মানূষের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এসব কারনেই তিনি খ্যাতি পেয়েছেন “উপকূল বন্ধু” হিসেবে।
এছাড়াও সবুজ বনায়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা সংগঠন আলোকযাত্রার প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল ইসলাম। দেয়াল পত্রিকার মাধ্যমে বিভিন্ন স্কূলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটি করে থাকেন তিনি। উপকূল সুরক্ষায় তাগিদে পালিত হওয়া ‘ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক- সবুজ উপকূল’ অনুষ্ঠানটির সফল আহবায়ক তিনিই। এছাড়া ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস হিসেবে পালনের উদ্দোক্তা ও প্রস্তাবক তিনি।
কাজের স্বীকৃতি হিসাবে মানুষের দোয়া এবং ভালোবাসার জোড়ে তিনি পেয়েছেন একাধিক এওয়ার্ড ও পুরস্কার। এর মধ্যে ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে তিনবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি বেস্ট রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন তিনি। পিআইবি-এটুআই গণমাধ্যম অ্যাওয়ার্ড, ইউনিসেফ-মীনা অ্যাওয়ার্ড, মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি পুরস্কার, এফপিএবি পুরস্কার, পিআইবি-ইউনিসেফ ফিচার পুরস্কার, ইউএনডিপি-বাংলাদেশ সরকার পুরস্কার, কানাডিয়ান অ্যাওয়ার্ড, একুশে সাহিত্য পুরস্কার এবং জাতীয় তরুণ সংঘ পুরস্কার অর্জন করেন তিনি।
সমুদ্র উপকূলবর্তী দুর্গম জনপদে ঘুরে ঘুরে খবর সন্ধান করতে গিয়ে নিজেই কখনো কখনো নিচ্ছেন জীবনের ঝুঁকি। নিচ্ছেন জীবনের ঝুকি। তার এই কাজের ফলে এরই মধ্যে উপকূলের রিপোর্টগুলো সংবাদ মাধ্যমের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তার রিপোর্টের মধ্যদিয়ে প্রান্তিক উপকুলীয় সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুজে পাচ্ছে। এমন করেই চেনা সকলের কাছে রফিকুল ইসলাম মন্টু যেন হয়ে উঠেছেন একজন উপকূলের বাতিঘর।
মন্টু ভাইয়ের সাংবাদিকতা জীবনের শতভাগ সময় কেটেছে মাত্র কয়েকটি টি শার্ট দিয়ে। গোল গলার সেই টি- শার্ট গুলোতে মিশে আছে সমগ্র উপকূলের মানুষের ছোয়া। লেগে আছে শত উপকূলীয় গল্পের ছোয়া। তার কাজের সাক্ষী ওই টি- শার্টগুলো।
প্রিয় মন্টু ভাই আপনার ঘামে ভেজা পুরাতন একটি টি শার্ট চাই আমি। স্মৃতি হয়ে থাকুক আমার কাছে, আমাদের কাছে। একটি টি শার্ট দেবেনে আমাকে?
0Share