মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর প্রতিবছর বাংলাদেশের মৎস্য পরিসংখ্যানের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বিরাট অংশ জুড়ে থাকে ইলিশের কথা, ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ, অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন এবং পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় প্রবণতা দেখানো হয়। ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে ২০০১ থেকে প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে বলে পরিসংখ্যানে উল্লেখ রয়েছে।
কিন্ত পরিসংখ্যানে উৎপাদন বাড়লেও ইলিশ মাছ সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সম্পূর্ণ বাহিরে। অনেক ভালো আয়ের মানুষও এখন ইলিশ কিনে খেতে পারে না। ঘাটে ও বাজারে ইলিশ নিয়ে নৈতিবাচক কথাবার্তা বন্ধ হচ্ছে না। ইলিশ উৎপাদনের সরকারি পরিসংখ্যান ও মাঠের বাস্তবতা মিলছে না।
সে প্রেক্ষিতে গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে ইলিশের উৎপাদন ও তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি নিয়ে লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন মাছঘাট সরেজমিনে খুঁজে দেখা হয়। এসময় জেলে, মাছঘাটের আড়তদার, ইলিশ ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় অন্তত ৫০জনের সাথে কথা বললে প্রত্যেকে ইলিশ পরিসংখ্যানের তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতিকে অনুমান নির্ভর বলে অভিযোগ করেছেন।
জেলেদের স্পষ্ট অভিযোগ
জেলে এবং মাছ ঘাটের আড়তদাররা দাবি করেছে জেলা মৎস্য বিভাগ থেকে শুরু করে মৎস্য অধিদপ্তর পর্যন্ত সবাই ইলিশ উৎপাদনের যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে তা অনুমান নির্ভর । এতে প্রতি বছর ইলিশ উৎপাদন বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখাচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে মৎস্য বিভাগের কোন কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী মাঠ থেকে ইলিশ উৎপাদনের কোন হিসেব সংগ্রহ করে না।
ইলিশের তথ্য সংগ্রহ নিয়ে কর্মকর্তা কি বলেছেন ?
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন জানিয়েছেন, গত ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে লক্ষ্মীপুর জেলায় ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ২৩ হাজার টন। এ প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে জেলা মৎস্য কর্মকর্তার নিকট জানতে চাওয়া হয়েছিল উৎপাদিত ইলিশের হিসেব কিভাবে সংগ্রহ করা হয় ? এমন প্রশ্নের উত্তরে মৎস্য কর্মকর্তা জানান, লক্ষ্মীপুর জেলাব্যাপি মেঘনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ২৫টি মাছঘাট রয়েছে। এসব ঘাটের মধ্যে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা, কমলনগর উপজেলা এবং রামগতি উপজেলার বড় ১২টি মাছ ঘাটে জেলা মৎস্য অফিসের পক্ষ থেকে ১২জন গণনাকারী রয়েছেন। গণনাকারীগণ প্রতি সন্ধ্যায় ইলিশের একটি দৈনিক হিসেবে মৎস্য অফিসে পাঠায়। সেখান থেকে তারা উৎপাদনের হিসেব করেন। গত প্রায় ৭ বছর যাবত গণনাকারীরা ইলিশের হিসেব করেন বলেও মৎস্য কর্মকর্তা জানিয়েছেন। কোন কোন ঘাটে গণনাকারী রয়েছে তার তালিকাও মুখে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা।
জেলে ও আড়তদারা বলেছে ইলিশের সঠিক হিসেব আসছে না
মৎস্য কর্মকর্তার হিসেব এবং তালিকা ধরে, সরেজমিনে লক্ষ্মীপুর জেলার একটি প্রসিদ্ধ মাছঘাট মতিরহাটে যাই। ঘাটে মাছ বিক্রির ৪২টি আড়ত রয়েছে। এ ঘাটের খুবই পরিচিতি আড়তদার মোঃ খোকন (৪০)। গত প্রায় ১৫ বছর যাবত মতিরহাট মাছঘাটে ইলিশ ক্রয় বিক্রয়ের সাথে জড়িত এ যুবক। খোকন জানায়, মতিরহাট মাছঘাটে মৎস্য বিভাগ বা অন্য কোন সংস্থার কোন গণনাকারী নেই। এমনটি হাস্যকর। এসময়, আড়তদার মিহির এবং ফারুকসহ খোকন জানায়, শুধু মতিরহাট না লক্ষ্মীপুর জেলার কোন মাছঘাটেই কেউ কখনো কোন হিসেব করে না, কেউ জানতে চায় না। তাছাড়া লক্ষ্মীপুর জেলার মাছঘাটগুলো ইলিশ বিক্রি হয় পিস হিসেবে। এখানে ওজনে মাছ বিক্রি হয় না। খোকন, মিহির এবং ফারুক স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে মৎস্য বিভাগ কখনো মাঠ থেকে কোন তথ্য সংগ্রহই করে না।
লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর বিভিন্ন ঘাট থেকে ইলিশ কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে ব্যবসায়ী মোঃ কবির হোসেন (৪৩) । তিনি জানিয়েছেন, মনগড়া হিসেব দেয় মৎস্য বিভাগ। এতে মাছের উৎপাদন প্রতি বছরই বেশি দেখানো হয়। বাস্তবে আসলে মাছের উৎপাদন বাড়ছে না। হয়তো কোন প্রকল্প চলছে । প্রকল্পের শর্ত হয়তো বছর বছর উৎপাদন বৃদ্ধি দেখাতে হবে। আমাদের জেলার হিসাবও তো সারা দেশের সাথে যোগ হয়। আমাদের জেলার হিসেব যদি মনগড়া হয় তাহলে সারাদেশের হিসেবও মনগড়া। কবির বলেন, ইলিশের সঠিক হিসেবে আসলে আসছে না।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার সেন্টার খাল মাছঘাট। জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম এ মাছঘাটে মাছ বিক্রির আড়ত রয়েছে ৫২টি। মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মাছ বিক্রি হয় এ ঘাটে। ইলিশের হিসেবে নিয়ে কথা হয় ঘাটের আড়তদার সফিকের সাথে। তিনি জানান, আলেকজান্ডার মাছঘাটে কখনো কোন গণনাকারী বা সরকারি, বেসরকারি কোন সংস্থা মাছের কোন হিসেব নেয় না। ঘাটটিতে ইলিশ বিক্রি হয় হালি(৪টি) বা পিস হিসেবে। ওজনে মাছ বিক্রি হয় না।
লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার মধ্যবর্তী এবং লক্ষ্মীপুর জেলার সবচেয়ে বড় মাছঘাটের নাম টাংকিবাজার। এঘাটে নদী ও সমুদ্রের মাছ বিক্রি হয়। ঘাটের আড়তদার তৌহিদ জানায়, টাংকি বাজার মাছঘাটে ইলিশ বিক্রি হয় পণ (৮০পিস) হিসেবে। ওজনে ইলিশ বিক্রি হয় না। তিনি জানান, টাংকিবাজার মাছঘাটে কোন সরকারি বা বেসরকারি লোক কখনো মাছের হিসেব নেয়নি।
কমলনগর উপজেলার কটরিয়া মাছঘাটের দোকানদার জামাল উদ্দিন (৪০) জানান, আমি দীর্ঘদিন ঘাটে দোকানদারি করি। এ ঘাটে সরকারি কিংবা অন্য কোন সংস্থার লোক কখনো এসে ওই দিন বা ওই মাসে কি পরিমাণ মাছ ক্রয় বিক্রি হয়েছে তার কোন হিসেব জিজ্ঞাসা করেনি। গত ২০ বছরের মধ্যে এমন কোন ঘটনা আমাদের জানা নেই। তিনি বলেন, সরকার প্রতি বছর ইলিশের যে হিসেব উপস্থাপন করে তা অনুমান নির্ভর ।
কটরিয়া ঘাটের জেলে সালেহ আহম্মদ (৬০) জানান, মৎস্য বিভাগ যেটা বলে সেটা হয়তো ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও কক্সবাজারের বাজারের মাছের ওজন হিসেব করে অনুমান নির্ভর একটা হিসেব প্রকাশ করেন। সেখানেও সমস্যা আছে কারণ সকল মাছ মোকামে যায় না। মাছের হিসেব করতে হবে ঘাট থেকেই। বর্তমানে যে হিসেব প্রতি বছর উপস্থাপন করা হয় তা মনগড়া বা অনুমান নির্ভর। ইলিশের মনগড়া হিসেবের কারণে দেশব্যাপি নানা বির্তক দেখা দেয়। মৎস্য বিভাগ বলে উৎপাদন বাড়ছে। কিন্ত নদীতে ভিন্ন চিত্র। জেলেরা মাছ পায় না। সাধারণ আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে ইলিশ।
জুলফিকার ব্যাপারী (৪৫) বলেন, লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য বিভাগ যে হিসেব দেয় সেটাও অনুমান নির্ভর এবং মুখস্থ। আমি ১০ বছর যাবত ব্যবসা করি। লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন ঘাটে গিয়ে মাছ কিনে নিয়ে চাঁদপুর বিক্রি করি। আমার এ ১০ বছরের জীবনে কখনো দেখি কোন সরকারি কর্মকর্তা কোন ঘাটে এসে মাছের হিসেব নিয়েছে।
লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন ঘাটে কিভাবে ইলিশ বিক্রি হয় ?
মৎস্য বিভাগের দেয়া তথ্যে জানা গেছে লক্ষ্মীপুর জেলায় নদী ও সাগরের মাছ বিক্রির জন্য ২৫টি মাছঘাট রয়েছে। স্থানীয় ভাবে তথ্য নিয়ে জানা গেছে, প্রত্যেকটি ঘাটে জেলেরা নদী ও সাগর থেকে মাছ এনে ঘাটের আড়তদারদের বাক্সে মাছ রাখে। এরপর উন্মুক্ত নিলামে হালি (৪টি) হিসেবে ইলিশ বিক্রি হয়।
কটরিয়া মাছঘাটের আড়তদার আলমগীর মোল্লা (৫০) বলেন, জেলেরা নদী থেকে মাছ ধরে ঘাট এনে আমাদের বাক্সে রাখে। এরপর আমরা নিলাম ডাক শুরু করি হালি (৪টি) হিসেবে। লক্ষ্মীপুর জেলার সকল ঘাটে একই ভাবে হালি হিসেবে ইলিশ বিক্রি হয়। কখনো ওজন করি না। ব্যবসায়ীরা অনুমান নির্ভর নিলামে মাছ কিনে নিয়ে পরে ওজন করে বাজার ও বড় মোকামে বিক্রি করে। ঘাট থেকে ওজন হিসেবে কোন ইলিশকেনা বেচা হয় না। আমি ব্যবসা করি ২০১৪ সাল থেকে। আমি কখনো দেখিনি কোন লোক এসে ইলিশের হিসেব নিতে।
জেলেরাও ইলিশ খেতে পারে না
স্থানীয় জেলে, আড়তদার এবং স্থানীয়রা জানিয়েছে প্রতি বছর সরকারি তথ্যে দেখা যায় ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। কিন্ত জেলেরা বলছে ইলিশ আসলে বাড়েনি। এক একটি নৌকা সারাদিন জাল মেরে ৪-৫টি বড়জোর ৮-১০টি ছোট ইলিশ পাচ্ছে। যা ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকাশ করে না। তাছাড়া প্রতিদিনই ইলিশের দাম বাড়ছে।
তালতলি মাছ ঘাটে জেলে মোহসিন, বেলায়েত এবং মনির বলেন, বর্তমানে ইলিশের দাম এত বেশি যে জেলেরাই মাসের পর মাস একটা ইলিশ খেতে পারেনা। দাম বেশি হওয়ায় তারা ইলিশ ধরেও খেতে পারেনা। জেলেরা জানান, ইলিশ বাড়লে ধরা পড়তো বেশি, তখন দাম কমতো। জেলেদের দাবি আসলে ইলিশের সঠিক পরিসংখ্যান আসছে না। এসি রুমে মনগড়া হিসেবে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না।
জেলে মহসিন বলেন, উৎপাদন বাড়ার হিসেব পাই মিডিয়ায়। কিন্তু যখন বাজারে ইলিশ পাওয়া যায় না এবং বেশি দামে ইলিশ বিক্রি হয়, তখন নানা সমালোচনা তৈরি হয়। আসলে মূল সমস্যা হচ্ছে ইলিশ উৎপাদনের পরিসংখ্যান।
মৎস্য অফিসের তথ্য মতে লক্ষ্মীপুর জেলায় গত বছর (২০২৩-২০২৪) ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ২৩ হাজার টন। মাছঘাট রয়েছে ২৫টি। সে হিসেবে প্রতিদিন লক্ষ্মীপুর জেলায় ৮২ টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল। ২৫টি ঘাটের প্রতিটিতে গড়ে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৩টন বা সাড়ে ৩ হাজার কেজি ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল। কিন্ত ঘাটের ব্যবসায়ীরা বলেন, ইলিশের আকালের কারণে প্রতিদিন সবগুলো ঘাটে ২০টন ইলিশও পাওয়া যায়নি।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদনের পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের দায়িত্বে রয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ।
মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যৌথভাবে বা পৃথকভাবে লক্ষ্মীপুরসহ দেশের ৩০টি জেলার হাট-বাজার, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, ঘাট ও নদী এলাকা থেকে ইলিশ আহরণের তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মৎস্য বিভাগ ডেটাবেস তৈরি করে।
তবে মাঠ পর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠানের ইলিশ গণনার কোন চিত্রই স্থানীয় জেলে ও ব্যবসায়ীরা দেখেনি। সে কারণে ইলিশের উৎপাদন পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ রয়েছে জেলে, মাছের আড়তদার ও স্থানীয়দের মাঝে। সে কারণেই আসলে দেশব্যাপি ইলিশ নিয়ে এত বির্তক হচ্ছে।
0Share