সব কিছু
facebook lakshmipur24.com
লক্ষ্মীপুর বুধবার , ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ , ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
লক্ষ্মীপুরের নারী ও কিশোরীদের হাতে তৈরি ৫কোটি টাকার টুপি রপ্তানি হয় মুসলিম বিশ্বে

লক্ষ্মীপুরের নারী ও কিশোরীদের হাতে তৈরি ৫কোটি টাকার টুপি রপ্তানি হয় মুসলিম বিশ্বে

লক্ষ্মীপুরের নারী ও কিশোরীদের হাতে তৈরি ৫কোটি টাকার টুপি রপ্তানি হয় মুসলিম বিশ্বে

সানা উল্লাহ সানু: পাঁচবেলা নামাজের পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ঈদে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে টুপি ব্যবহার করে। মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে টুপির বাজার বছরজুড়ে। কিন্ত বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের নারী ও কিশোরীদের হাতে তৈরি বিশেষ একধরনের টুপি রপ্তানি হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের বহু দেশে। প্রতি মাসেই হাতের কাজের টুপি তৈরিতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন হাত, বাড়ছে রপ্তানি। স্বচ্ছতা আসছে গ্রামের দরিদ্র নারীদের সংসারে। এসব তথ্য জানিয়েছে টুপি তৈরির কারিগরা।ৃ

আর ব্যবসায়ীরা বলছে টুপি রপ্তানি করে দেশের আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ওয়েব সাইটে দেয়া তথ্যে জানা যায় বাংলাদেশ ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে ৪৪৭.৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের টুপি রপ্তানি করে। রপ্তানি করা টুপির মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগই বাংলাদেশী নারী ও কিশোরীদের হাতে তৈরি নকশী টুপি। দেশের অন্তত ১৫টি জেলায় তেরি হয় এমন টুপি। টুপির বিভিন্ন পর্যায়ের কারিগরি ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

ঢাকার বাইরে লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, নওগাঁ, বগুড়া, রংপুর, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, পাবনা, সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় নারী ও কিশোরীদের হাতে তৈরি হয় বিশেষ এক টুপি। হাতে তৈরি এসব টুপি শতভাগ বিদেশে রপ্তানি হয়।

লক্ষ্মীপুর জেলার স্থানীয় কারিগর, টুপির এজেন্ট ও ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধির সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের চারটি উপজেলায় অন্তত দুই লাখ নারী ও কিশোরী হাতের নকশী টুপি তৈরি করে। লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৫ লাখ টুপি ব্যবসায়ীদের হাত হয়ে বিদেশে রপ্তানি হয় । এতে কারিগর ও ব্যবসায়ীদের মাসে গড়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার বেশি আয় হয়। স্থানীয় প্রবাসীরা বলছে, ‘মেইড ইন বাংলাদেশ” মাথায় নিয়ে ঘুরছে বিশ্বের বহুদেশের মুসলিমরা। মুসলিম বিশ্বে তৈরি হচ্ছে হাতে তৈরি টুপির বড় বাজার।ৃ

কোথায় রপ্তানি হয় ?
লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডার বাজারের টুপি ব্যবসায়ী আশরাফ, জহির উদ্দিন এবং নুরনবী জানায়, হাতে তৈরি টুপির প্রধান ক্রেতা দেশ ওমান । এছাড়া সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, কাতার, মালয়েশিয়ায় টুপি রপ্তানি হয়।

বাংলাদেশী নারীদের হাতে বানানো টুপির এত চাহিদা কেন ?

দীর্ঘদিন ওমানে প্রবাসী ছিলেন, সিরাজ উদ্দিন এবং সৌদি আরবে প্রবাসী রয়েছেন মোঃ কবির হোসেন। এ দুজন জানায়, বাংলাদেশী নারীদের হাতে সুই সুতার কাজের মান এবং চমৎকার ডিজাইনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমরা মেশিনে তৈরির টুপির পরিবর্তে হাতের নকশায় তৈরি টুপি বেশি কিনেন। সিরাজ জানায় ওমানের এমন কোন মার্কেট নেই যেখানে বাংলাদেশী টুপি পাওয়া যায় না। অন্যদিকে কবির জানায মক্কাসহ সৌদি আরবের বড় বড় ব মার্কেটে বাংলাদেশি হাতে তৈরি টুপির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। হজ্বের সময় বিভিন্ন দেশের হাজীরা বাংলাদেশী নারীদের হাতে তৈরি টুপি ক্রয় করে থাকেন।ৃ

গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে টুপি তৈরি করছে নারীরা:
লক্ষ্মীপুরের দরিদ্র প্রবণ উপজেলা কমলনগর, রামগতি, সদর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চল এবং রায়পুর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলের চরাঞ্চলের নারী ও কিশোরীরা মূলত হাতে তৈরি টুপির প্রধান কারিগর। বর্তমানে অনেক সচ্ছল পরিবারের নারীরাও বাড়তি আয়ের জন্য টুপি তৈরি করছেন। কমলনগর ও রামগতির প্রায় ৮০ ভাগ বাড়িতে টুপি তৈরি হয়।

কমলনগর উপজেলার উত্তর চর লরেঞ্চ গ্রামের বিলাত আলী বাড়ির অন্তত ৩০ জন নারী হাতে তৈরি টুপির কারিগর। এ বাড়ির জেসমিন আক্তার (৩০) জানায়, গত ১০ বছর যাবত সংসারের কাজের ফাঁকে টুপি বুনন করে মাসে গড়ে সাড়ে ৪ হাজার টাকা আয় হচ্ছে তার। ২৫ বয়সী ফাতেমা জানায়, টুপি তৈরির আয় দিয়ে তিনি স্বামীকে সংসারের জন্য সাহায্য করছেন।

কিশোরী জান্নাত বেগম (১২) স্থানীয় একটি স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ছে। জান্নাত জানায় গত মাসে সে টুপি তৈরি করে ২ হাজার টাকা মুজুরি পেয়েছিল। সে টাকা দিয়ে স্কুলের ব্যাগ ও জুতা কিনেছে। বাড়ির অন্য নারী ও কিশোরীরা মাসে ২-৪ হাজার টাকা আয় করছেন।

চর মার্টিন গ্রামের মধ্য মার্টিন গ্রামের নুসরাত জাহান (১৪)। এ কিশোরী স্থানীয় একটি মাদরাসায় সপ্তম শ্রেনীতে পড়ে। নুসরাত জানায় পড়ালেখার পাশাপাশি অবসর সময়ে সে মাসে ২টি টুপি তৈরি করতে পারে। এতে তার আয় হয় ২ থেকে ৩ হাজার। যা দিয়ে তার পড়ালেখার খরচের পাশাপাশি বাবার সংসারে খরচ দিচ্ছে সে।

একই গ্রামের প্রায় সব বাড়ির প্রতিটি ঘরের নারী ও কিশোরীরা বাড়তি আয়ের প্রত্যাশায় টুপি তৈরি করছে। নারীরা জানায়, সব গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে অন্তত ২-৩ জন নারী ও কিশোরী টুপি তৈরি করছে।ৃ

হতদরিদ্র নারীরা সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এ নকশী টুপি বুনন করে পরিবারের বাড়তি রোজগার করছেন। লাভজনক হওয়ায় পড়াশোনার পাশাপাশি টুপি বুননের কাজে নেমে পড়েছেন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীরাও। এতে করে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসে গ্রামীণ জনপদের এসব পরিবারের মাঝে।

ব্যবসায়ী আশরাফ জানায়, রামগতি উপজেলা হচ্ছে টুপি তৈরির প্রধান এলাকা। রামগতিতে ১ লাখের বেশি নারী প্রতি মাসে প্রায় ৩ লাখ টুপি তৈরি করেন। রামগতির চর আলেকজান্ডার, চর সেকান্তর, শেখের কেল্লা গুচ্ছগ্রাম, রামগতি বাজার এলাকা, চররমিজ, চরকলাকোপা এলাকার প্রত্যেক নারী টুপি তৈরি করে।

শুধু মুসিলম নারীরা নয়, সনাতন ধর্মের নারীরাও জড়িত হচ্ছেন। রামগতি পৌরসভার সাহাপাড়া, চরহাছান হোসেন ও পন্ডিত পাড়াতে এ কাজের সাথে জড়িয়ে থাকা প্রায় শতাধিক সনাতন ধর্মাবলম্বী নারী প্রতিদিন বুনে চলছেন টুপি।

ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যে জানা যায়, কমলনগরের ৫০-৬০ হাজার নারী ও কিশোরী প্রতি মাসে গড়ে ১ লাখের বেশি টুপি তৈরি করে। কমলনগর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের কালকিনি ইউনিয়নে মতিরহাট কলোনী, চর লরেঞ্চ, চরফলকন, চর জাঙ্গালিয়া, চরকাদিরার চরঠিকাসহ সবগুলো এলাকার প্রায় সব বাড়িতেই টুপি তৈরি হয়।

সদর উপজেলার চর রমনীমোহন, রায়পুর উপজেলার উত্তর চর বংশী এবং দক্ষিণ চর বংশী এলাকায় কমপক্ষে ৫০ হাজার নারী ১ লাখ টুুপি তৈরি করে থাকে।

আলেকজান্ডার বাজারের টুুপি ক্রেতা কারিমুল হক বিপ্লব জানায়, প্রতি মাসে তিনি প্রায় ৫ হাজার টুপি ক্রয় করেন। একই বাজারে অন্তত ২শ জন ক্রেতা টুপি ক্রয় করেন। প্রত্যেকে মাসে ২-৫ হাজার টুপি ক্রয় করেন। কমলনগরে ২০-২৫জন, সদর উপজেলায় ২০ জন এবং রায়পুরে ১৫-২০ জন টুপি ক্রেতা রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানায় লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে মাসে প্রায় ৫ লাখ টুপি রপ্তানি হয়। যেগুলো তৈরিতে প্রায় ৫ কোটি টাকা মুজুরি পায় কারিগর ও স্থানীয় এজেন্ট ও ব্যবসায়ীরা।

কিভাবে আসলো এ ব্যবসা ?

স্থানীয়রা জানায়, আশির দশকে ফেনী জেলার প্রবাসী কয়েকজন বাসিন্দার হাত ধরে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে টুপি তৈরি শুরু হয়। এখন পুরো জেলায় ছড়িয়ে পুড়েছে। শুধু লক্ষ্মীপুরেই না, দেশের উপকূলীয় অঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলে টুপির কারিগর বেশি।

কারিগর থেকে রপ্তানি পর্যন্ত বহুহাত ঘুরে প্রতিটি টুপি:

স্থানীয় কয়েকজন নারী জানায়, টুপি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় জাপানি কাপড় ও ভারতীয় সুতা। কাপড় ও সুতা কিনে নকশার নমুনা দিয়ে গ্রামের নারীদের কাজ বুঝিয়ে দেয় ব্যবসায়ীর এজেন্টরা। নকশা করা টুপি তৈরিতে ১১টি ধাপ রয়েছে। কাপড় কাটা, ইস্ত্রি করা, নকশা আঁকার পর সুঁই-সুতার বুননে তা ফুটিয়ে তোলা। নকশা তোলা শেষে আবার কাটিং করে ধোলাই ও ইস্ত্রি করা হয়। লাগানো হয় টুপির অংশ (টপ)। যন্ত্রে আঁকা নকশা ফুটে ওঠে সুঁই-সুতার বুননে। পরে কাপড়গুলো সেলাই করে তৈরি হয় টুপি। নারীরা মূলত সুঁই-সুতার বুনন করে।

কারিগর কোহিনুর, জেসমিন, মুন্নী বেগম জানায়, টুপির কাপড়, সুতা এবং ডিজাইনের মানের ওপর ভিত্তিক করে প্রতিটি টুপি তৈরির জন্য নারী কারিগররা ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা মুজুরি পান। একএকটি টুপি তৈরি করতে কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ দিন সময় লাগে।

বড় ব্যবসায়ীদের কিছু এজেন্ট নারীদেরকে মাঠ পর্যায়ে এসে টুপি দিয়ে যান। এজেন্টরা পায় টুপি প্রতি ৫০-১শ টাকা। বড় এজেন্টদের থেকে ছোট এজেন্টরা ২০-৫০ টাকা হারে নিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে নারীদের হাতে তুলে দেয়। এরা পায় প্রতি টুপিতে ২০ টাকা। বড় এজেন্টদের থেকে উপজেলা ও ইউনিয়ন ভিত্তিক টুপি কিনে নেয় ব্যবসায়ীরা এরা পায় ৩শ-৫শ টাকা। এরাই ঢাকার বড় ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করে। বড় ব্যবসায়ীরা ওয়াশ করে রপ্তানিকারকদের হাতে তুলে দেয় টুপি ।

স্থানীয়রা কি বলে ?
কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামলীগ সভাপতি মোঃ নিজাম উদ্দিন জানায়, তার ইউনিয়নেই প্রায় ১০-১৫ হাজার পরিবার দৈনন্দিন সংসারের কাজের ফাঁকে নকশী টুপি বুনন করে বাড়তি রোজগার করছে। এ নকশী টুপি বুনন শিল্পের কারিগরদের জন্য জেলা ভিত্তিক বাজার গড়ে তুলতে পারলে কারিগররা আরো বেশি পারিশ্রমিক পাবে। এবং জেলার জন্য একটি
ব্র্যান্ডি পণ্য তৈরি হবে। পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে।

কর্মকর্তারা কি বলেন ?
লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্পনগরী উপ-ব্যবস্থাপক মোঃ আসাদুল্লাহ হাসান জানান, তিনি জেলায় নতুন যোগদান করেছেন। সেকারণে হাতে তৈরি টুপির বিষয়ে তার কোন ধারণা নেই।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাড থেকে অনুবাদকৃত।

প্রতিবেদন আরও সংবাদ

লক্ষ্মীপুরের নারী ও কিশোরীদের হাতে তৈরি ৫কোটি টাকার টুপি রপ্তানি হয় মুসলিম বিশ্বে

লক্ষ্মীপুর থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত মেঘনা নদীতে ১৬ চর | কমেছে ইলিশ; নদীপাড়ের মন্দার প্রভাব

লক্ষ্মীপুর থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত মেঘনা নদীতে ১৬ চর | চরে আটকে যাচ্ছে জীবন ও অর্থনীতি

লক্ষ্মীপুরে বছরে ১১ কোটি ঘনফুট উর্বর মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়

প্রবাসী স্বামী ওপর জেদ করে কোলের শিশুকে রেখে যান ভিক্ষুকের কোলে; জানিয়েছে শিশুর মা

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে লক্ষ্মীপুর ও পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির

লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ে অনলাইন নিউজপোর্টাল প্রকাশনার নিবন্ধনের জন্য আবেদনকৃত, তারিখ: 9/12/2015  
 All Rights Reserved : Lakshmipur24 ©2012-2022
Chief Mentor: Rafiqul Islam Montu, Editor & Publisher: Sana Ullah Sanu.
Muktijudda Market (3rd Floor), ChakBazar, Lakshmipur, Bangladesh.
Ph:+8801794 822222, WhatsApp , email: news@lakshmipur24.com