কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুজ্জামান জানান, হাজিরহাটে জারিরদোনা শাখা খালের অবৈধ ৮০ জন দখলদারদের একটি তালিকা সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে। যার মধ্যে ১১টি বহুতল ভবন এবং ৬৯টি আধাপাকা ও টিনশেড ভবন রয়েছে।
পাঁচ উপজেলার লক্ষ্মীপুরের সর্বকনিষ্ঠ কমলনগর উপজেলার প্রধান শহর হাজিরহাট। লক্ষ্মীপুর জেলা শহর হতে ৩২ কিলোমিটার দূরের হাজিরহাট বাজারের ওপর দিয়ে উত্তর দক্ষিণে আঁকাবাঁকা পথে ছুটে ছিল জারিরদোনা শাখাখাল। ২০০০ সাল পর্যন্ত খালটি ছিল এ অঞ্চলের কৃষি ও অর্থনীতির বাহক এবং জীব বৈচিত্র্যরক্ষার একমাত্র জীবন্ত সত্ত্বা।
বর্তমানে মানুষের দখলের খুঁটি, বিল্ডিংয়ের দেয়াল আর আর্বজনায় বাজারের প্রায় ৬শ মিটার জায়গায় খালটি শ্বাসবন্ধ হয়ে করুণ ভাবে মরে গেছে। কিন্ত খালটির এমন দুর্দিন ও মৃত্যু শয্যায় পাশে নেই প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ অন্য কেউ। বাজারের উত্তর দিকে আরো ১ কিলোমিটার মেরে ফেলার সব আয়োজন চলছে। একটি খালের এমন নির্মম মৃত্যু দেখে নিজের আবেগ প্রকাশ করে কথাগুলো বলেছিলেন, স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ মনির হোসেন।
কমলনগরের চরফলকন, চর জাঙ্গিলিয়া, জাজিরাসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের অন্তত অর্ধশতাধিক বাসিন্দাদের সাথে কথা বললে সকলে খালের এ অবস্থার জন্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন।
চর জাঙ্গিয়া এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন ও হারুনুর রশিদ এবং ফলকন-জাজিরা এলাকার বাসিন্দা আঃ বারেক ও সিরাজদের অভিযোগ, গত ২০-২২ বছর যাবত অসংখ্য মানুষ খালে ও খালপাড়ে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলায় নদীর সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বাজারের উত্তর এলাকা। কিন্ত বরাবরই প্রশাসন নীরব ছিল, দখলদারদের কোন বাঁধা দেয়নি বলে জানান এ দু ব্যক্তি।
অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন সারাদেশে নদী, খাল ও জলাশয় দখলকারীদের যে তালিকা তৈরি করেছিল ওই তালিকায় হাজিরহাট বাজারের কোন দখলদারদের নাম নেই।
স্থানীয় আবদুল মালেকের অভিযোগ, সেই তালিকায় নাম না থাকলেও জারিরদোনা শাখা খালটি দখল করেই গত ২০-৩০ বছরে হাজিরহাট বাজারের অসংখ্য দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বহুতল ভবন গড়ে তোলা হয়েছে।
সিরাজ জানান,
বাজারে খাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজিরহাটের উত্তরের ফলকন, জাজিরা, চর জাঙ্গালিয়াসহ ৫ গ্রামের হাজার একর জমিতে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। সামান্য বৃষ্টিতে এলাকায় জলাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। খালের পানি ও আবর্জনা পচে এলাকায় উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। খালটি এখন কৃষক ও এলাকাবাসীর খলার কাটা হয়ে গেছে।
রবিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাজারের মধ্যভাগে থাকা আল মদিনা ও আল্লাহর দান রেষ্টুরেন্টের জ্বালানি ছাই, পঁচাবাসি খাবার, রান্নার আর্বজনা ফেলে সম্পূর্ণ রুপে খালের চিহ্ন মুছে দেয়া হয়েছে। এ দু রেস্টুরেন্টের পিছনে এখন খাল বলতে আর কিছু নেই। হাজিরহাট বাজারের খাল ও খালপাড়ে ১১টি বহুতল ভবন এবং প্রায় শতাধিক আধা পাকা ও টিনশেড দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে।
বাসার মাঝি নামের একজন জানায়, বাজারে রামগতি-লক্ষ্মীপুর সড়কের পশ্চিম পাশে যত বিল্ডিং ও টিনশেড ভবন করা তৈরি হয়েছে সবগুলোকে টেনে নিয়ে খালের ওপর রাখা হয়েছে।
স্থানীয় নুর নবী জানায়, পুরো বাজারের সব ময়লা আর্বজনা ফেলা হচ্ছে বাজারের উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য ভাগের খালে। বাজারের দক্ষিণে খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে একটি গণশৌচাগারের টাংকি। নানা প্রক্রিয়ায় বাজার সীমানার প্রায় ৬শ মিটার খাল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে মরে গেছে।
মো. সেলিম জানায়, হাজিরহাট বাজারের উত্তর মাথা থেকে উত্তর দিকে প্রায় ১ কিলোমিটার জুড়ে খালের পশ্চিম পাড়ে তৈরি হচ্ছে বেশ কিছু বহুতল ভবন। ভবনে যাতায়াতের জন্য খালের উপর অপরিকল্পিতভাবে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণ করে বাজারের উত্তর দিকের পানি প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে। ভবনে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ভবনের বাসিন্দাদের ব্যবহৃত বর্জ্য-আবর্জনা ফেলার পর ময়লার স্থানে নতুন নতুন ভবন তৈরি করে খালের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
মো. হানিফ মাঝি (৮০) জানায়, হাজিরহাট ইউনিয়ন ও চলফলকন ইউনিয়নকে বিভক্ত করেছে এ খাল। তিনি প্রায় ৪০ বছর এ খালে নৌকা চালিয়েছেন। স্বাধীনতার ১০ বছর পরেও এ খাল দিয়ে পণ্যবাহী নৌকা চলাচল করতো। ২০-২২ বছর আগেও এ খাল দিয়ে পণ্যবাহী নৌকা চলতো। হাজিরহাট বাজারে সরকারি গুদামে মালামাল আসতো এ খাল দিয়ে। খালের পানি ব্যবহার হতো কৃষকদের ক্ষেতে। জোয়ার ভাটায় দেশীয় মাছ ধরতো স্থানীয়রা। আশপাশের অন্তত পাঁচটি গ্রামের কয়েক হাজার অধিবাসী বিভিন্নভাবে এ খাল কাজে লাগাতো। এখন খাল দিয়ে বৃষ্টির পানিও গড়ায় না।
সরেজমিনে খালটি সরেজমিন পরিদর্শন কালে জানা যায় কমলনগর এবং রামগতি উপজেলার সীমান্তবর্তী মেঘনা নদী থেকে কমলনগর উপজেলার ফায়ার সার্ভিস অফিস পর্যন্ত জারিরদোনা শাখা খালের দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার। চলার পথে মেঘনাপাড়ের পাটারিরহাট মাছ ঘাট থেকে শুরু করে ১ কিলোমিটার দূরে খায়েরহাট স্লুইচ গেটে মিলিত হয় এ খাল। পরে স্লুইচ গেট থেকে আকাঁবাঁকা পথে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে হাজিরহাট বাজার হয়ে উত্তর দিকে ২ কিলোমিটার গিয়েং ফায়ার সার্ভিসের পিছনে মৌলভী বজলুর রহমানের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়।
স্থানীয় ভাবে জানা গেছে ২০০৬ সালে সাবেক রামগতির উত্তরাঞ্চলের ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত কমলনগর উপজেলা গঠন হয়। উপজেলা গঠনের পরপরই প্রশাসনিক আর ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে হাজিরহাট বাজারের পরিধি বাড়তে থাকে। ফলে ঘরের চাহিদা ও সুযোগ থাকায় স্থানীয়রা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সহায়তায় রামগতি-লক্ষ্মীপুর সড়কের পশ্চিমপাশ ও খালের পূর্ব-পশ্চিমপাড় জারিরদোনা শাখা খালের ওপরে গড়ে তোলে হয় বহুতল ভবন, শতাধিক আধাপাকা ও টিনসেট দোকান ঘর।
নুর হোসেন ও মো. হেলাল জানিয়েছেন, বাজারে খালের মৃত্যুর পর গত কয়েক বছর জমিতে চাষাবাদ করতে পারছেন না তারা। হয় তো পানি বেশি থাকে নয় তো পানি থাকে না। সামান্য বৃষ্টি হলে বাড়িতে পানি জমা হয়। খালে জোয়ার ভাটা নেই। প্রবাহমান খাল মেরে যখন গড়ে উঠছে শত দোকানপাট ও ভবন তবুও প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধি কারো যেন কোন পদক্ষেপ নেই।
কমলনগর প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আলী মিঠু বলেন, খাল উদ্ধারে প্রশাসনের কোন নজরদারি নেই। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হলেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। বরং তাদের গাফিলতির কারনে দিন দিন অবৈধ দখলদাররা খালকে গিলে খেয়ে ফেলেছে।
এ বিষয়ে কমলনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী জানান,
খালটি এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও কৃষির জন্য খুবই জরুরী। প্রশাসন খালটি দখল মুক্ত করতে পারলে ঔখানে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে খালের জীবন ফিরিয়ে দেয়া হবে।
কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুজ্জামান জানান,
হাজিরহাটে জারিরদোনা শাখা খালের অবৈধ ৮০ জন দখলদারদের একটি তালিকা সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে। যার মধ্যে ১১টি বহুতল ভবন এবং ৬৯টি আধাপাকা ও টিনশেড ভবন রয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, প্রশাসন খুব শীঘ্রই সেখানে অভিযান চালিয়ে খালটি দখল মুক্ত করবে।
215Share