রফিকুল ইসলাম মন্টু : ২৫ মে, তারিখটা মনে আছে? এদিন ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রলয় আছড়ে পড়েছিল পশ্চিম-উপকূলে। ২০০৯ সালের কথা। আজ থেকে এগারো বছর আগে। এখনও ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে খুলনার দাকোপ, কয়রা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনির বহু মানুষ।
আইলার এগারো বছর পূর্ন হওয়ার মাত্র ছয়দিন আগে পশ্চিম উপকূলে ঝাঁকুনি দিয়ে গেল আরেক ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এই ঘূর্ণিঝড়ের মূল কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে গেলেও ডানা ঝাপটায় ক্ষতবিক্ষত করে গেছে পশ্চিম উপক‚লের ভঙ্গুর, নড়বড়ে বাঁধ আর জনবসতি। আইলার ক্ষতকে আরও জাগিয়ে দিয়ে গেল এ ঘূর্ণিঝড়।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার মানুষেরা এগারো বছরে প্রায় কাটিয়ে উঠেছিল আইলার ক্ষত। সবুজহীন জনপদে উঁকি দিয়েছিল সবুজ। গাছপালা জন্মাতে শুরু করেছিল। হারিয়ে যাওয়া কৃষি আবার ফিরে আসছিল। ধান, সবজি, রবিশস্য ফলানো শুরু হয়েছিল। যদিও আইলার পর নড়বড়ে বাঁধ সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল গাবুরাবাসীর।
এগারো বছরে বহু আশ্বাস পেয়েছে এলাকার মানুষ। গত বছরের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ফণীর পরে দুই মন্ত্রী গিয়ে বলেছিলেন, শক্ত উঁচু বেড়িবাঁধ হবে; কিন্তু হয়নি। তারই ফলাফল আম্পানের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়া। এখন গোটা ইউনিয়নের মানুষ পানির তলায়। যে বাঁধের বড় জোয়ারের চাপ সহ্য ক্ষমতা নেই; সে বাঁধ আম্পানের এই বড় ধাক্কায় কীভাবে টিকবে? আইলা প্রলয়ের পর গাবুরা নামটি দেশে বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি পায়।
সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার এই দ্বীপ ইউনিয়নটি ভেসে গিয়েছিল সেদিন। অনেক লেখালেখি হয়েছে। দেশি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে এসেছে অনেক খবর। কিন্তু গাবুরা বদলায়নি। ফিরে পায়নি আগের চেহারা। এ দ্বীপ থেকে বহু মানুষ চলে গেছে অন্যত্র। মানুষের পেশা বদল হয়েছে। বসতির সংকট, কর্মসংস্থানের সংকট লেগেই আছে। আর এখানকার সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে নাজুক বেড়িবাঁধ। ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতা পর্যন্ত যেতে হয় না; সামান্য অমাবশ্যার জো-তেই কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়। পানি বাড়ে, জোয়ারের প্রবল চাপে পানি ঢোকার ভয় বাড়ে। লবনাক্ততা বেড়ে গোটা দ্বীপটিই যেন পুড়ে গেছে। ফসল হয় না।
সবুজের দেখা পাওয়া যায় না। সুপেয় পানির অভাবও তীব্র আকার ধারণ করেছে। লবনাক্ততা বেড়ে যাওয়া আর সুপেয় পানির অভাব শুধু গাবুরায় নয়। গোটা শ্যামনগর উপজেলাকেই যেন লবনাক্ততায় গ্রাস করে ফেলেছে। এরফলে একদিকে চাষাবাদে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে সুপেয় পানির সংকট বেড়ে গেছে। আইলার ক্ষত এখনও স্পষ্ট খুলনার দাকোপের কালাবগিতে। মানুষের ঠাঁই হয়েছে ঝুলন্ত ঘরে।
সুন্দরবনের গা ঘেঁষে এই গ্রামটিকে আইলা দিয়ে গেছে নতুন পরিচয়। বাঁশের খুঁটির সঙ্গে জোয়ার সমান কাঠের পাটাতন, পাতার ছাউনি। আইলা প্রলয়ের পর এগারো বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি এই জনপদ। বিপন্ন, বিবর্ণ সেখানকার চেহারা। নোনা জলের প্রকোপ বেড়েছে, বসতি আর কর্মসংস্থানে পড়েছে বিরূপ প্রভাব। এগারো বছর এই কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে পশ্চিম উপকূলের মানুষেরা। আইলার পর এগারো বছরে অনেক উন্নয়ন হলো; ক্ষত শুকালো না।
কালাবগির ঝুলন্ত পাড়া তেমনই রয়ে গেল। আরেক ঘূর্ণিঝড় এই মানুষগুলোর নড়বড়ে অবস্থাকে আরও নড়বড়ে করে দিয়ে গেল। মাটির রাস্তা। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শিবসা নদী। ওপারে সুন্দরবনের সবুজ স্পষ্টই দেখা যায়। নদী তীরে সারি সারি ঝুলন্ত ঘর। যতদূর চোখ যায়, একই দৃশ্য। এ যেন বাংলাদেশের অন্যরকম এক চেহারা। পড়েনি আলো। নেওয়া হয়নি পুনর্বাসনের উদ্যোগ। ঘূর্ণিঝড় আইলা এই এলাকার মানুষের এই নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছে।
যারা এখন ঝুলন্ত পাড়ায় বসবাস করছেন, তাদের প্রত্যেকেরই বাড়িঘর ছিল, ঘরের সামনে উঠোন ছিল, কারো বা ছিল পুকুর। সাচ্ছন্দেই ছিল জীবনযাপন। আইলার প্রলয়ের পর ক্ষয় হতে হতে সবার ভিটে চলে গেছে নদীতে। আশ্রয়ের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র ছিল, উঁচু বাঁধ ছিল- সবই চলে গেছে। আইলা প্রলয়ের কথা মনে করে এখনও ডুকরে কেঁদে ওঠেন কালাবগির মানুষ। এগারো বছর আগের চেহারার সঙ্গে এখনকার চেহারার কোন মিল খুঁজে পান না এলাকাবাসী।
খুব ভালো ছিলেন তারা। বেড়িবাঁধ, রাস্তাঘাট, হাটবাজার, আয় রোজগারের ব্যবস্থা, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা- সবই ছিল এখানকার মানুষের। এখন সেসব অতীত। ভিন্ন এক দৃশ্যপট, ভিন্ন এক জগতের বাসিন্দা এখানকার মানুষেরা। কালাবগির পশ্চিম পাড়ায় রুহুল আমীনের দোকান। কেবল ভোরের আলো ফুটেছে। দু’একজন মানুষ ঘর থেকে বের হতে শুরু করেছেন। দোকানের সামনে ভিড় বাড়ছে। বাইরের অচেনা লোক দেখে আরও কিছু উৎসুক নারী-পুরুষ ছুটে এলেন। শুনতে থাকি একের পর এক সমস্যার কথা। আবদুল মজিদ নামের একজন ভির ঠেলে এসে বললেন- ‘কী আর বলবো সাহেব, আমাদের তো সব গেল। আইলা আমাদের শেষ করে দিয়ে গেছে।’ তর্জনী তুলে নদী আর সুন্দরবন দেখিয়ে বলেন- ‘ওখানেই আমাদের জীবিকার সব ব্যবস্থা ছিল। নদীতে আমরা মাছ ধরতাম, সুন্দরবনেও ছিল অনেক কাজ। সেসব এখন প্রায় বন্ধ। চলছি ধারদেনা করে।’
মাইনুদ্দিন ফকির, যার বয়স ষাটের কাছাকাছি, তিনি এসেছেন কথা শুনতে, কিছু বলতে। বললেন- ‘বাড়ি ছিল ওই নদীর মাঝখানে। এই জীবনে দশবার বাড়ি বদল করেছি। আগে যে এলাকাটি কী ভালো ছিল। আয় রোজগারের ব্যবস্থা ছিল। মানুষজন খেয়েপড়ে ভালো দিন কাটিয়েছে। সব খরচ বাদে কিছু মানুষ অর্থকড়িও জমাতে পারতো। কিন্তু এখন সঞ্চয় তো দূরের কথা, তিনবেলা সংসার খরচ চালিয়ে নেওয়াই কষ্টকর।’ মাইনুদ্দিন ফকিরের সঙ্গে কথা বলার সময় চোখ যায় নদী তীরের বাড়িঘরের দিকে। শিবসায় ভাটার টান।
কিনার থেকে অনেক দূরে নদীর পানি। কয়েকটি ডিঙি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কাদা মাটিতে। ভোরের মক্তব থেকে বের হয়ে আসা কয়েকটি শিশু লেখছে নদীর ধারে। বড়দের সংকট শিশুরাও কিছুটা বোঝে। ওরা হয়তো এককিছু বোঝে না- তবে টানটানির সংসার ওদের সব প্রয়োজন হয়তো মেটাতে পারে না। ঝুলন্ত পাড়ার বাসিন্দা হালিমা বেগম বলছিলেন- ‘এক ছেলে আর এক মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছি। কীভাবে পড়াবো। নিজেরা তো খেতেই পারি না!’ ভিড়ে জড়ো হওয়া শিশুদের সঙ্গে আলাপ করি। ওদের অনেকেই স্কুল ছেড়ে কাজে নেমেছে। ঝুলন্তপাড়ার সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি।
এক পাশে ফসলি জমি। ধানের আবার বেশ ভালোই। অন্যপাশে সারিবদ্ধ ঝুলন্ত ঘর এবং তার পরে নদী। বর্ষায় ঘরের কাঠের পাটাতন পর্যন্ত পানি ছুঁয়ে যায়। পাড়ায় হাঁটতে গিয়ে সবচেয়ে বড় হয়ে চোখে ভাসে সুপেয় পানি সংকটের চিত্র। রাস্তার পাশে বড় সাইজের কতগুলো প্লাস্টিকের ড্রাম। মুখ আটকানো। উপরে আমার মাটি দিয়েঢেকে রাখা হয়েছে। এগুলো কী? প্রশ্ন করতেই ঘরের পাশ থেকে এসে মনজিলা বেগম বললেন- ‘এগুলোতে আমাদের খাবার পানি। চালনা থেকে আনা হয়েছে। মাটি দিয়ে ঢেকে না রাখলে পানি চুরি হয়ে যায়।’ পানি চুরি হয় কথাটা শুনলেই অনুমান করা খুব সহজ- এখানে পানির মূল্য অনেক বেশি। মনজিলা বেগম, ছকিনা বিবি, মর্জিনা বেগমদের কথায় সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তারা জানালেন- ‘পানির অপর নাম জীবন। সেই পানি আমাদের নাগালের অনেক দূরে। বর্ষাকালে আমাদের পানি সংকট কিছুটা কমে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে পারি। কিন্তু শুকনোয় সংকট সীমা ছাড়িয়ে যায়। চালনা, এমন কি কখনো কখনো খুলনা থেকেও আমরা খাবার পানি সংগ্রহ করি।’ কালাবগিতে কী হয়েছে? কী করা যেতে পারে? এ বিষয়ে আলাপ হলো খুলনা ভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রূপান্তর-এর নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম খোকন। এই সংস্থাটি আইলার পরে কালাবগিতে অনেক ধরণের কাজ করছে। খোকন বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলা এই এলাকার মানুষের জীবনধারা বদলে দিয়ে গেছে।
আইলার পর এ এলাকায় অনেক কাজ হয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু ঝুলন্ত পাড়ার মানুষের জীবন সেভাবে বদলানো যায়নি। এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। কারণ এখানে জমি নেই। ভাঙনের তীব্রতা অনেক বেশি। ফলে এই মানুষদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়ার জরুরি বলে মনে করেন তিনি। রফিকুল ইসলাম খোকনের কণ্ঠে মেলালেন ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার মোনতাজ সানা।
তিনি বলেন, অবকাঠামোগত সমস্যা তো আছেই। পানি সমস্যাটাও ব্যাপক। প্রতিটি পরিবারে দেড় হাজার লিটারের একটি করে ট্যাংক দিতে পারলে পানির সংকট মিটবে। আইলার ক্ষত এখনও স্পষ্ট শ্যামনগর, আশাশুনি, কয়রা, দাকোপ, মংলা, শরণখোলার বেশ কয়েকটি স্থানে। অধিকাংশ স্থানে বেড়িবাঁধ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। স্বাভাবিক জোয়ারেও এসব স্থান দিয়ে পানি ঢোকে। ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পেলে মানুষের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে।
এই নড়বড়ে অবস্থার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাত এই জনপদের অনেক এলাকা তছনছ করে দিয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জোট বেঁধে বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করছেন। আইলার পর থেকে এগারো বছরে অনেক কাজ হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়েছে নানামূখী কর্মসূচি। লবনাক্ততা কমানো, ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, বাঁধ সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য- কী কাজ হয়নি? সবই হয়েছে।
কিছু এলাকায় ইতিবাচক ফলও পাওয়া গেছে। তবে অধিকাংশ স্থান এখনও নাজুকই রয়ে গেছে। তাই এগারো বছর পরেও একই কথা বলতে হচ্ছে- আজও আইলার ক্ষত শুকায়নি। ফিরেনি প্রাণ।
171Share