প্রথমবার যখন বিয়ে চেষ্টা হয়, তখন শারমিন কেবল প্রাথমিকের চৌকাঠ পেরিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেছিল। প্রস্তাব এসেছিল ভোলার এক গ্রাম থেকে। নানান উপায়ে বিয়ে ঠেকিয়েছে শারমিন নিজেই। লেখাপড়াটা চালিয়ে নেওয়ার দৃঢ় ইচ্ছে তার।
কিন্তু তার এই অদম্য ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় বাবার পরিবারের দারিদ্র্য। মেয়েকে সরাতে পারলে তার খরচ কমে। তাই সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার পর শারমিনকে দ্বিতীয় দফা বিয়ে মোকাবেলায় লড়াই করতে হয়। প্রস্তাব এসেছিল পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা থেকে। নানান কৌশলে ছেলেপক্ষ ফিরে যায়। শারমিন বেশ ভালো ফলাফল করে আসছিল।
ক্লাসের প্রথম অবস্থানটি নিতে পারেনি কেউ। অভাবের সংসারে বাবা কী এই ফলাফলের মর্ম বোঝে! অষ্টম শ্রেণীতে ওঠার পর তার ওপর আবার বিয়ের চাপ। ছেলেপক্ষ থেকে আসে ছেলের বাবা-মাসহ আরও কয়েকজন।
ভয় বাড়ে শারমিনের। এবার বুঝি আর রক্ষা নেই! সে ছুটে যায় ক্লাসের সবচেয়ে প্রিয় স্যারের কাছে। তিনি যোগাযোগ করেন স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে। চাপ আসে শারমিনের বাবার ওপর- এ বিয়ে হবে না। শারমিন জয়ী হয় তৃতীয়বারের মত। তবে নাছোড়বান্দা বর পক্ষ। এই বাড়ি থেকে তাদের মেয়ে নিতেই হবে।
অবশেষে শারমিনের পিঠাপিঠি ছোট বোন আছমা বেগমকে বিয়ে দেওয়া হয় ওই বরের সঙ্গে। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে তিন তিন বার বিয়ে ঠেকানো সেই শারমিন এবার এইচএসসি পরিক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চরফ্যাসন সরকারি কলেজ থেকে সে এবার পরিক্ষা দিবে।
এসএসসিতে এ প্লাস পেয়েছিল। চরফ্যাসন সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ২১৩জন শিক্ষার্থীর মধ্যে তার অবস্থান তিন চারের মধ্যে। গোটা চরমোন্তাজ ইউনিয়নের মধ্যে প্রথম শ্রেণী থেকে দশম পর্যন্ত তার অবস্থান ছিল প্রথম।
পঞ্চম উত্তীর্ণ হয়ে আসা ১০৯ পড়–য়ার মধ্যে মেধা যাচাইয়ে তার অবস্থান ওঠে শীর্ষে।ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবে- এই স্বপ্ন নিয়ে শারমিন ভর্তি হয়েছিল বিজ্ঞান শাখায়।
পরিক্ষাগুলোতে বেশ ভালো করছে। আগের ফলাফলের ধারাবাহিকতা এখানেও অব্যাহত থাকবে- আশাবাদ শারমিনের। কিন্তু পরের ধাপের জন্য এখনই চিন্তা তার। এসএসসি’র পর মেডেকেলে ভর্তি কোচিং থেকে শুরু করে অন্যান্য খরচ কোথা থেকে আসবে!
শারমিনের বাড়ি উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দ্বীপ চরমোন্তাজ ইউনিয়নে। সেখানকার চরমোন্তাজ এ. সাত্তার মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালের এসএসসি পরিক্ষায় এ প্লাস পায় শারমিন আক্তার। বাবা ফারুক মাঝি বিভিন্নভাবে রোজগারে সংসারের চাকা সচল রেখেছেন। বদলি মজুরির কাজ করেছেন বহুদিন।
অবশেষে কয়েকজন মিলে একটি ট্রলার কিনেছেন। চরমোন্তাজের বাইলাবুনিয়া থেকে যাত্রীবাহী এ ট্রলারটি প্রতিদিন ভোলার কচ্ছপিয়ায় যায়। সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে আবার ফেওে বাইলাবুনিয়ায়। খরচ বাদে যে অবশিষ্ট অর্থ থাকে, এটা দিয়েই চলে ফারুক মাঝির সংসার।
বাবা ফারুক মাঝি বলছিলেন, ‘মেয়ের লেখাপড়ায় তো অনেক কিছুই প্রয়োজন। কিন্তু তা দিতে পারি না। বইপত্র কিনে দিতে হয়। ভালো জামাকাপড় দিতে হয়। স্কুলে যাওয়ার সময় হাতে কিছু টাকা দিতে হয়। তা তো ঠিকঠাক দিতে পারিনা। ওর খোঁজ নিতে পারিনা। আয় রোজগার যা হয়, সংসার চালাতেই কষ্ট হয়।
তবুও সাধ্যমত চেষ্টা করি।’ ছোটবেলা থেকে চরম অভাবের মধ্যদিয়ে বেড়ে ওঠা শারমিনের মেধার প্রমাণ অবাক করে দেয় শিক্ষাকদের। গ্রাম থেকে আসা একটি মেয়ের ক্রমাগত ভালো ফলাফলে হতবাক তার শিক্ষকেরা।
চরফ্যাসন সরকারি কলেজে শারমিনের রসায়ন স্যার মো. জসিম উদ্দিন, ইংলিশ স্যার মো. জাকির হোসেন, পদার্থ বিজ্ঞান স্যার নজরুল ইসলাম, গণিত স্যার মিজানুর রহমান, জীববিজ্ঞান স্যার কামরুজ্জামান ফ্রি পড়াচ্ছে শারমিনকে। তারা চান ভালো ফলাফল করে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছুক শারমিন। শারমিন জানায়, তাকে বাড়িতে পড়িয়ে দেওয়ার মত কেউ নেই। প্রাইভেট পড়ার মত টাকা নেই। অস্টম শ্রেণী পর্যন্ত কোন প্রাইভেট ছিল না।
নবমে এসে প্রাইভেট পড়েছে। তবে স্যারেরা তার কাছ থেকে কোন টাকা নেয়নি। বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের স্কুলে প্রতিদিন তাকে পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে। ডাক্তার হাওয়ার স্বপ্ন শারমিনের। এই পেশায় সেবা নিয়ে মানুষের পাশে থাকতে চায়। আর তাই লেখাপড়ায় প্রবল মনযোগ ছোটবেলা থেকেই। দারিদ্র্যতা আর অর্থকষ্ট ওকে দমাতে পারেনি শারমিনকে।
বাবা-মা কোন ওর কোন শখই পূরণ করতে পারেনি। ঘরে ছিল না পড়ার পরিবেশ। আবছা আলোতে পড়ে এই বয়সেই ওর চোখটাও নষ্ট হয়েছে। কখনো না খেয়েই স্কুলে গিয়েছে। ভাগ্যে জুটেনি পুষ্টিকর কিংবা বাড়তি খাবার।
অনেক সহপাঠী টিফিনে ভালো মেনু যোগ করতে পারলেও ওর পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। স্কুলে আসা যাওয়ায় প্রতিদিন দু’ঘন্টা সময় নষ্ট হয়েছে। কখনো স্কুলে যেতে হয়েছে না খেয়ে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের গন্ডিতে কখনোই প্রাইভেট পড়ার সুযোগ মিলেনি। তবুও পরিক্ষায় ক্রমাগত ভালো করেছে শারমিন। ঐচ্ছিক বিষয় ছাড়া এসএসসিতে শরমিনের প্রাপ্ত মোট নম্বর ৮৭১।
ঐচ্ছিক বিষয় থেকে যোগ হয়ে এই নম্বর দাঁড়িয়েছে ৯১৭। দশ বিষয়ে তার গড় নম্বর ৮৭ দশমিক এক। ‘এ প্লাস’ পেয়েছে ৭ বিষয়ে। বাকি ৩টিতে পেয়েছে ‘এ’। বাংলায় ১৫৬ (এ), ইংরেজিতে ১৬৩ (এ প্লাস), গণিতে ৭৯ (এ), বাংলাদেশ গেøাবাল স্টাডিজে ৮৮ (এ প্লাস), ইসলাম ধর্মে ৮১ (এ প্লাস), পদার্থবিদ্যায় ৯০ (এ প্লাস), রসায়নে ৭৭ (এ), জীববিদ্যায় ৮৮ (এ প্লাস), তথ্যপ্রযুক্তিতে ৪৯ (এ প্লাস) এবং কৃষি শিক্ষায় ৮৬ (এ প্লাস) নম্বর পেয়েছে।
দরিদ্র পরিবারে থেকেও যে মেধার সাক্ষর রাখা যায়; অনেকের থেকে এগিয়ে থাকা যায়; তারই প্রমাণ শারমিন। দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজের নয়ারচর গ্রামে বাড়ি। বাবা মো. ফারুক মাঝি অতিকষ্টে ৯ জনের সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। মা রাবেয়া বেগম হাজারো বাঁধা পেরিয়ে কাজ করছেন নেপথ্যে। ৭ ভাইবোনের মধ্যে শারমিন ৩য়। ছোটবেলা থেকে ওর ভালো ফলাফল দেখে ছোট ভাইবোনেরাও অনুপ্রাণিত।
0Share